শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিদুর্ঘটনা বৃদ্ধি ও সতর্কতা

অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নিয়ম-কানুন মেনে চলা এবং সতর্ক থাকা প্রয়োজন। না হলে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। সেটা কারোরই কাম্য নয়।
অলোক আচার্য
  ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই বহু ধরনের দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা অন্যতম। গত কয়েক বছরে এই দুঘর্টনায় প্রাণহানিসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে অগণিত মানুষের স্বপ্ন। প্রাণহানি যেমন ক্ষতিকর তেমনি একজনের সম্পদ পুড়ে যখন তার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন ছাই হয়ে যায় তার খোঁজ কে রাখে। প্রাণহানির সংখ্যা আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাই। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গের খবর রাখি না। অথচ কতদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সেই স্বপ্ন জমা হয়। তারপর একদিন হঠাৎ আচমকাই সব পুড়ে ছাই হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অসাবধানতাবশত যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনার পেছনে কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তা থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার প্রকারে অগ্নিকান্ডজনিত দুর্ঘটনা তাই বর্তমানে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে এবং কীভাবে এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যায় বা কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কারণ একমাত্র সচেতনতা এই দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এসব সংঘটিত অগ্নিকান্ড হচ্ছে বৈদু্যতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বা অসাবধানতার ফলে। এসব অগ্নিকান্ড এবং এর পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতিবিষয়ক দুর্ঘটনায় প্রায়ই প্রাণহানি এবং মালামাল বিনষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে মাত্র এক বছরে দেশে আগুন লাগার ঘটনা প্রায় ২২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে প্রাণহানির ঘটনা। ২০১৯ সালে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২৪,০৭৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ হয়ে ১৮৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। আহত হয়েছে ৫৮৬ জন। যেখানে তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে দেশে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ছিল ১৯,৬৪২টি। সে বছর প্রাণ হারিয়েছিল ১৩০ জন। এক বছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ২০১৭ সালে এই দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৮,১০৫ এবং প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৪৫ জনের। এখানেও বৈদু্যতিক শর্ট সার্কিটই অগ্নিদুর্ঘটনা একটি বড় কারণ বলে দেখা গেছে। শতকরা ৩৯ ভাগ অগ্নিকান্ড এই কারণে ঘটছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের বৈদু্যতিক সরঞ্জামের ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। নিম্নমানের বৈদু্যতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করে মানসম্পন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত। এতে শর্ট সার্কিটের ঘটনা কমানো সম্ভব।

চলতি বছরের শুরুতেই দেশে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছাই হয়েছে মানুষের স্বপ্ন। আমাদের অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা দক্ষ হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। সবসময় আমরা দেখি ঘটনার পর যতদ্রম্নত সম্ভব তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। আস্থা রাখি সেই মানুষের ওপর। অনেক সময় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা দ্রম্নত কাজ করতে পারেন না। কাজ করতে গিয়ে সেই সব সাহসী মানুষও হতাহত হয়। তাদেরও ঝুঁকি থাকে। সেই ঝুঁকি উপেক্ষা করেও তারা দায়িত্ব পালন করেন। যারা এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে তাদের চোখের জল মুছতেই বহু বছর পার হয়ে যাচ্ছে। গত বছরের চকবাজার ট্র্যাজেডির কথা মনে আছে? একুশে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম প্রহরে দেশবাসী যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর তখন পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরো জাতি হতবিহ্বল, স্তম্ভিত। সবার চোখ ছিল টিভি পর্দায়। একের পর এক মৃহদেহ, পোড়া, আধপোড়া। কত মানুষের স্বপ্ন নিমেষেই ছাই হয়ে গেল। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন নিভে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে পুড়ে যাওয়া স্বপ্নের সংখ্যা। নিমতলীর পর চকবাজার। দুই এলাকার দূরত্বও বেশি নয়। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল, আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে। যা দেশে অগ্নিকান্ডের আর একটি বড় কারণ। চকবাজারের আগুন দ্রম্নতগতিতে বিস্তার লাভ করেছিল কেমিক্যালের কারণে। নিমতলীতেও ভয়াবহ আগুনের পেছনে এই কেমিক্যাল ছিল। আমাদের দেশে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়।

নিমতলীর এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি সেখান থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল। চকবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়েছে আরও কয়েকটি কারণে। তার কয়েকটি হলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির প্রবেশমুখ সরু, ঘটনাস্থল থেকে পানির উৎসের দূরত্ব। যে কোনো স্থানেই অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যাতে সহজেই আগুন নেভানোর কাজটি করতে পারে তার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে বাড়িঘর তৈরি করতে হবে। এর আগেও জলাশয়ের অভাবে আগুন নেভানোর কাজ তরান্বিত করা যায়নি। অথচ ঢাকা শহরের এমন অবস্থা যে হাতে গোনা কয়েকটি জলাশয় অবশিষ্ট আছে। দখলের কবলে সব জলাশয়। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মহলে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নাহলে নিমতলী বা চকবাজারের মতো দুর্ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।

কোনো ঘটনা থেকে কেবল শিক্ষা নিয়ে বসে থাকলেই পরবর্তী ঘটনা আটকানো যায় না। ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তা যেন আর না ঘটে বা ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায় তা বাস্তবায়ন করাই আসল কাজ। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃতু্যর ঘটনা আমাদের দেশে একেবারেই সাধারণ। যানবাহনে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোও খুব সাধারণ একটি ঘটনা। বলা হয় মেয়াদোত্তীর্ণ একটি সিলিন্ডার একটি বোমার মতো মারাত্মক। চলন্ত গাড়িতে এরকম বোমা নিয়ে দেশের অনেক স্থানেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। যে কোনো সময় আমি বা আপনি যে গাড়িতে চড়ে বসে আছেন নিশ্চিন্তে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হয়তো সেটিতেই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। এরকম বহু ঘটেছে আমাদের দেশে। এই বিষয়টি নিয়ে বহু কথা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই না হওয়াতেই আমাদের যত অপারগতা। গাড়িতে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার আছে কিনা তা সাধারণ যাত্রীর জানার কথা নয়। জনগণের জীবন নিয়ে যারা ছেলেখেলা করে তাদের বিরুদ্ধে জোরদার পদক্ষেপ কেন নেয়া হয় না। দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক কিছু করার প্রতিশ্রম্নতি দেয়ার চেয়ে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে সেই দিনটাই হয়তো আর দেখতে হয় না।

বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বহু অগ্নিকান্ডের ঘটনা এবং তার ফলে মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আমাদের চোখের সামনেই যে কোনো দোকানে গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করতে দেখা যায়। অথচ আইন অনুযায়ী এই গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য অনুমতির প্রয়োজন এবং সব ধরনের দোকানে বা যত্রতত্র বিক্রি করা যায় না। আবার এই সিলিন্ডারগুলোর মেয়াদ কতটা সতর্কতার সঙ্গে নির্ণয় করা হয় তাই বা কতজন ব্যবহারকারী জানে। সিলিন্ডার ব্যবহারেও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। পত্রিকার পাতায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেগুলো জানতে হবে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর সতর্কতা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে।

অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নিয়ম-কানুন মেনে চলা এবং সতর্ক থাকা প্রয়োজন। না হলে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। সেটা কারোরই কাম্য নয়।

অলোক আচার্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89751 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1