শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ুদূষণের প্রভাব এবং প্রতিকারের উপায়

পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাজমুন্নাহার নিপা
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

পরিবেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান হচ্ছে মাটি, পানি এবং বায়ু। মানুষ, উদ্ভিদ এবং জীবজন্তু সবকিছুর বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। পরিবেশ আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। সুস্থ পরিবেশের ব্যত্যয় মানুষ এবং পশুপাখির মৃতু্য পর্যন্ত ঘটাতে পারে।  বর্তমানে সময়ের বহুল আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে বায়ুদূষণ যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক হারে বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন-২০১৯, বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর বায়ুদূষণজনিত মৃতু্যর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। ২০১৪ সালের (ডঐঙ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে বায়ুদূষণে সারা বিশ্বে ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বারবারই সতর্ক করেছে। আরেকটি সংস্থার জরিপ বলছে, চলতি বছরে বায়ুদূষণের প্রভাবে বিশ্বের প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃতু্য ঘটতে পারে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রগুলোতে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া এবং রাজশাহী অঞ্চলের নগর এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়া ঢাকার তুলনায় কম। পৃথিবীর সব দেশে বা সব স্থানে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের হার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পরিবেশ দূষণ বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যখন বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থের কণা ও ক্ষুদ্র অণু অধিক অনুপাতে মিশে থাকে তখন আমরা এটাকে বায়ুদূষণ বলে থাকি। শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বায়ুদূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। তবে বায়ুদূষণের বড় দুইটি উপাদান হলো শিল্পকারখানার বর্জ্য ও যানবাহনের ধোঁয়া। ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি কল, কাগজ কল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারি শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাত কল প্রভৃতি শিল্প-কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এ ছাড়াও কৃষি জমি থেকে উৎপন্ন ধুলা এবং উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও উপকূলীয় ভূমি এলাকায় নিকটস্থ সমুদ্র তরঙ্গসৃষ্ট লবণ কণা দ্বারা বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের এসব উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধূলিকণা উৎপন্ন হয়- যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে কয়েক প্রকার শিল্প-কারখানা যেমন ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত বস্ত্র ও ট্যানারি কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মোনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলো একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের বিরক্তি কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব দূষক মাথাধরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। অধিক হারে নগরায়নের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অধিকতর হারে বায়ুদূষণ ঘটছে। ঢাকা শহরের ভিওসি গ্রহণযোগ্য সীমার বাইরে  রয়েছে, যাদের কয়েকটি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঢাকার দুই-স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিক্সাসমূহ থেকে নির্গত ধোঁয়ায় গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়ে ৪ থেকে ৭ গুণ বেশি ভিওসি পাওয়া গিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা  দায়ী ৫৮%, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮%, যানবাহন ১০%, বায়োমাস পোড়ানো ৮% এবং অন্যান্য ৬% দায়ী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। অনেকেই মনে করি, নরমাল বসবাসের রুমের চাইতে এসি করা রুম বায়ুদূষণমুক্ত। এটা মোটেও ঠিক নয়। সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ুদূষণের পরিমাণ নরমাল বসবাসের রুমের বায়ুদূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হতে পারে। এসি রুমে হয়তো ঠান্ডা বাতাস পাচ্ছি, কিন্তু শুদ্ধ ঠান্ডা বাতাসের পরিবর্তে অধিকতর দূষিত ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যায়। তাই রুমে আলো আসা বা খোলা বাতাস পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন কারণের ফলেও বায়ু দূষণ হয়ে থাকে। এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ও পশুপাখির মৃতদেহ ফেলা। তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বায়ু দূষিত হয়। জ্বালানি হিসেবে তেল, বিষাক্ত ও সীসাযুক্ত গ্যাস ব্যবহার, যান্ত্রিক যানবাহন, বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। গাছ কাটা, বনে আগুন লাগা বা অন্য কোনো কারণে বন কমে গেলে বায়ুমন্ডল দূষিত হয়। ক্ষেত খামারে ব্যবহৃত কীটনাশক ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য বায়ুদূষণ করে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধে যেসব বোম, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য গোলাবারুদ ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে বায়ুদূষণ হচ্ছে। এসব অস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহারেও বায়ুদূষণ হয়। বায়ুদূষণের কারণে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বায়ুতে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সিসা নির্গত হচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সিসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। মধ্যম আয়ের নগর এলাকা অথবা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের রক্তে গড় সিসার মাত্রায় উলেস্নখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সিসা দূষণ মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করা ছাড়াও বৃক্কের সচলতাকে নষ্ট করে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। শিশুদের রক্তে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি তাদের মস্তিষ্ক এবং বৃক্ককে নষ্ট করে ফেলতে পারে। পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের তুলনায় শিশুরা সিসা দূষণে তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের মৃতু্যর কারণ হলো বায়ুদূষণ, এসবের মাঝে ৭৫ শতাংশ মৃতু্যই ঘটে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে, বাকি ২৫ শতাংশ হয় ফুসফুসের রোগে। শুধু তাই নয়, এত মৃতু্যর ৭৫ শতাংশ ঘটে এশিয়া মহাদেশে, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ- বিশেষ করে চীন এবং ভারতে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা এ ব্যাপারটাকে আরো শক্তপোক্ত করেছে যে, দূষিত বায়ু বেশ কিছু দিক দিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম। যেমন: শুক্রাণুর ক্ষতি, জন্মগত ত্রম্নটি  স্ট্রোকের ঝুঁকি, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।  বায়ুদূষণ মানসিক সমস্যাও বাড়ায়। দেখা যায়, বায়ুদূষণের পরিমাণ যত বেশি হয়, মানুষের হতাশা, বিষাদ, অস্থিরতা এবং অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতির প্রকোপ ততই বেশি হয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানা যায়, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে হতে পারে হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ। অ্যালকোহল, কফি যেভাবে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী, বায়ুদূষণও সেভাবেই দায়ী, ৫-৭ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের পেছনে বায়ুদূষণকে দায়ী করা যায় বলেন গবেষকরা। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে- যা মানুষকে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দেয়। তীব্র বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের বুদ্ধি কমে যাওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে এক নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যৌথভাবে চীনে চালিয়েছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ার বেশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের এক নতুন গবেষণা থেকে জানা যায়।  বায়ুদূষণের ফলে শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতি নয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়, ফলে এর প্রভাব পড়ে জলবায়ুর ওপর এবং তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান বায়ুদূষণের বিষয়টিতে বিশ্বেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই বুঝতে শিখেছে বায়ুদূষণ একটি ভয়াবহ আতঙ্ক। তবুও জনগণের সচেতনতার পর্যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অবধি পৌঁছতে পারেনি। বায়ুদূষণ থেকে রেহাই পেতে আমাদের বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, পরিবেশবান্ধব ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্প-কারখানা গড়তে হবে, বাতাসে ক্ষতিকারক উপাদান ছড়াতে পারে এমন জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ ও নিষিদ্ধ করতে হবে, ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বায়ুতে রাস্তার ধুলাবালি উড়া বন্ধ করতে বা কমাতে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পশুপাখির মৃত দেহ, ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, বাহিরে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, রাস্তা নির্মাণ বা মেরামতের কাজ দ্রম্নততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যাতে করে যেখানে সেখানে নগর বর্জ্য বা কৃষি বর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ সমস্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার ভেতর পরিবেশবান্ধব মনোভাব তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অন্যান্য সংস্থা ও জনগণ সমন্বিত উদ্যোগ নিলে সুফল বয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন হওয়া উচিত। সর্বোপরি, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

নাজমুন্নাহার নিপা: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89896 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1