দেশে মাদক এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। অনেক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, বহুসংখ্যক গ্রেপ্তার হয়েছে আর অনেকেই চলমান অভিযানের ভয়ে দেশ থেকেই পালিয়ে গেছে। এই অভিযান শুরুর পর থেকেই সাধারণ মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছে। কিছু সমালোচনা ছাড়া এই অভিযান নিয়ে সবাই আশাবাদী। প্রতিটি কাজেই সমালোচনা থাকে। কিন্তু মাদক নিমূর্ল কাজটি সহজ কাজ নয়। কারণ এই বিষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। অভিযানের মধ্যেও দেশে ইয়াবা ঢুকছে। দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী মিয়ানমার থেকে ইয়াবা দেশে আসছে। সেজন্য উৎসমুখে সবোর্চ্চ সতকর্তা প্রয়োজন। ইয়াবা বতর্মান সমাজের সবচেয়ে বড় কঁাটা। নেশার উপাদানের মধ্যে মাথাব্যথার বড় কারণ ইয়াবা। তরুণ সমাজের কাছে ইয়াবা সবাির্ধক জনপ্রিয় এবং পাচারের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সহজ। এর কারণ ইয়াবার গঠন। ছোট ট্যাবলেট আকৃতির এই নেশাদ্রব্য যে কোনো স্থানে অধিক পরিমাণ লুকিয়ে রাখা যায়। নেশাগ্রস্তদের কাছে ইয়াবা ‘বাবা’ নামে পরিচিত। ইয়াবার নেশায় আজ দেশের যুব সমাজ বঁুদ হয়ে রয়েছে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এর বিস্তার এতটাই ভয়াবহ যে সামনে কোনোভাবেই এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মাদকদ্রব্যই যদিও সমস্যার মূল কারণ কিন্তু ইয়াবা এত অল্প সময়ে এত ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছে যে অন্যসব মাদক গ্রহণ এর কাছে যেন নস্যি। ইয়াবার আকার, রং এবং সমাজের উঁচুস্তরে ব্যবহার ইয়াবার জনপ্রিয়তার বড় কারণ। হাত বাড়ালেই শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল সব জায়গায় ইয়াবা মিলছে। আর আকারে ছোট হওয়ায় এর বহনও সহজ। প্রায়ই চোরাইপথে এমন সব অভিনব উপায়ে ইয়াবার চালান আটক হয় যে তা পত্রিকার পাতায় পড়লে রীতিমতো শিহরণ জাগে। ইয়াবার ব্যবসায় প্রায় সব শ্রেণি-পেশার লোক জড়িত রয়েছে। অল্প সময়েই টাকার পাহাড় গড়া যায় বলেই এই ব্যবসায় এত আকষর্ণ। কোটি কোটি টাকার পাহাড়, আলিশান বাড়ি, দামি গাড়ির লোভ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ইয়াবার ব্যবসায় নামাচ্ছে। এটা এমন একটি চেইন যেখানে উপর থেকে একেবারে তৃণমূল পযর্ন্ত মাদকাসক্তের হাতে পেঁৗছে যাচ্ছে। তার খুব কম পরিমাণই আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। তা ছাড়া প্রতিদিন জড়িত হচ্ছে নতুন নতুন ব্যক্তি। আর প্রতিদিন আসক্ত হচ্ছে কোনো কিশোর বা যুবক। ইয়াবার বিষ এতটাই ভয়ঙ্কর যে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করাটা দুঃসাধ্য বলে মনে হচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইয়াবা সম্পকের্ নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করতে সক্ষম। মাদকে ঘিরে ফেলছে সমাজ। প্রতিটি স্তরের নারী-পুরুষই মাদকে আসক্ত। এত এত সচেতনতা সত্তে¡ও কিন্তু এর ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। নিত্য-নতুন মাদকের আবিভার্ব ঘটছে। বিড়ি, সিগারেট, জদার্, তামাক পাতা, গঁাজা, ফেনসিডিল, ভাং থেকে শুরু করে হালের ইয়াবা এখন শহরের গÐি পেরিয়ে গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঢুকে কালো থাবা বিস্তার করে বসেছে। যার প্রভাবে শিক্ষিত তরুণ সমাজ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সবর্নাশা মাদকের দিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ছাত্রসমাজ। অনেক ছাত্রের স্কুল ব্যাগে বই-খাতার সঙ্গে থাকছে মাদকদ্রব্য। এমন কোনো পেশা নেই যে বা যারা ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে না। ভয়টা এখানেই বেশি। যাদের অন্যদের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালন করার কথা তারাই এই পথে পা বাড়াচ্ছে। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পকের্ লেখা থাকে। টিভিতে নেশাজাতীয় কোনো পদাথের্র দৃশ্য এলেও এর ক্ষতিকরের দিকটা লেখা থাকে। এটা দেখেও কিন্তু সবাই সিগারেট, মদ খায়। পরিণতি জেনেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা কেন। আজকের দিনে শিশুরাও বিড়ি-সিগারেট কিনছে খাচ্ছে। যে কেউ হাত বাড়ালেই পাশের কোনো দোকান থেকে কিনতে পারছে ইয়াবা। প্রশাসন প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইয়াবার থাবা কমাতে কিন্তু শষের্র মধ্যেই বহু ভ‚ত লুকিয়ে আছে। আছে উপর মহলের চাপ। কোমলমতি শিক্ষাথীের্দর জীবনে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে এই ইয়াবা। কত সংসার ভেঙে যাচ্ছে এই ইয়াবার জন্য। কত মা-বাবার সঙ্গে আদরের সন্তানের বিচ্ছেদ ঘটছে ইয়াবার জন্য। হালের এই মাদকটি সত্যিই দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অন্ধকার থেকে কেউ কেউ বের হতে পারলেও বেশির ভাগই সেই অন্ধকারেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই অন্ধকার থেকে তাদের গন্তব্য হচ্ছে কারাগার, রাস্তায় মৃত্যু অথবা বেঁচে থাকলে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো। আজ পযর্ন্ত এটাই হয়েছে।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইয়াবাই এখন এগিয়ে। এর বিস্তার এত ভয়ঙ্কর আকারে হয়েছে যে তা শিক্ষাথীর্র ব্যাগে পযর্ন্ত স্থান করে নিয়েছে। মাদকে আসক্ত কেন হয়। কেনই বা তারা বই, খাতা, কলম ছেড়ে মাদকের মতো সবর্নাশের পথে পা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভ‚মিকা কতটুকু সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। কোনো অন্যায় প্রতিরোধে আইন যথেষ্ট নয়। আইনের সঙ্গে সচেতনতা মিলে রোধ করা সম্ভব একটি অপরাধকে। একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। তারপর সমাজের সব স্তরের মানুষকে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় আমাদের গ্রামে-গঞ্জে ছোট ছোট ছেলেদের মাদকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে পরিবারের সদস্যদের হাত ধরেই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। প্রথম তামাকজাতীয় নেশা সেখানেই প্রত্যক্ষ করে। হাতের নাগালের মধ্যেই সেগুলো থাকে। আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরে খুব প্রচলিত তামাকজাত দ্রব্য হলো বিড়ি বা সিগারেট, জদার্ (যা বেশির ভাগ পরিবারের নারী-পুরুষই পানের সঙ্গে খায়), ও গুল। এসব এতটাই সহজলভ্য ও হাতের নাগালে থাকে যে ইচ্ছা করলেই এসব কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা তা পরখ করতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা এই সময়টাতে থাকে কৌত‚হলী। যে কোনো জিনিসের প্রতি থাকে অদম্য কৌত‚হল। এভাবে আনতে আনতে এবং তা বাড়িতে কাউকে খেতে দেখে সেও তা মুখে নেয়। দেখা যায় প্রথমে কৌত‚হলবশত অনেকেই শিশু বয়সেই মাদকের সংস্পশের্ আসে।
ইয়াবার আকষর্ণীয় ছোবলে আজ ধংসের অনেক কাছে পেঁৗছে গেছে দেশ। প্রতিদিন পাচার হয়ে দেশের ভেতর ঢুকছে ইয়াবা। ইয়াবার কারণে কত ছেলে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে তার হিসাব কে রাখে। কত ভাই তার বোনের ¯েœহ থেকে দূরে গেছে তারও হিসাব নেই। সেসব হিসাব রাখাও সম্ভব নয়। তবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ দুঃসাধ্য কিন্তু অসাধ্য নয়। তবে এর জন্য কেবল প্রশাসনের দারস্থ হয়ে বসে থাকলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। সমাজের প্রতি দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ইয়াবা তথা মাদকের বিরুদ্ধে সচেষ্ট হতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এসব মাদকের কুপ্রভাব বোঝানোর মাধ্যমে। তারা যেন কোনোভাবেই কোনো বন্ধু বা অন্য কোনো উপায়ে অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে ইয়াবা আসক্ত না হয় পরিবারের সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কোনো কাজ যত চ্যালেঞ্জেরই হোক না কেন তা চেষ্টা করলে করা সম্ভব। ইয়াবার বিস্তার বন্ধ করা দুঃসাধ্য কিন্তু অসাধ্য নয়।
মাদকদ্রব্যগুলোর মধ্যে ইয়াবা নিয়ে বেশি আলোচনা করার কারণ ইয়াবাই আজ গ্রামে-গঞ্জে এমনকি কুঁড়েঘরে পযর্ন্ত পেঁৗছে গেছে। এর সহজে বহনযোগ্যতা ও আকষর্ণীয় রং এবং ইয়াবা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ইয়াবাকে মাদকাসক্তের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে ইয়াবার ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য মাদকদ্রব্য যেমন ফেনসিডিল বা গঁাজাও মাদকসেবীদের কাছে বেশি প্রিয়। আগেই বলেছি মাদকাসক্তের ব্যবহার কমাতে কেবল প্রশাসনই যথেষ্ট নয়। পরিবার থেকে আরও বেশি সচেতনতা বা সন্তানদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ পরিবার যদি কঠোর ভ‚মিকা পালন করে তাহলে প্রতিটি পরিবার থেকে মাদকাসক্তের পরিমাণ কমবে। কারণ মাদকাসক্তের পরিবারই জানে একজন মাদকাসক্ত সন্তানের কি যন্ত্রণা। তা ছাড়া দেশের অনেক মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ নিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে। এসব কেন্দ্রের পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের মূল হোতাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ যারা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের ধরার সঙ্গে সঙ্গে বেশি গুরুত্বপূণর্ হলো যারা এসব মাদকদ্রব্য সরবরাহ করে।
উৎসমুখ দিয়ে যাতে ইয়াবা না ঢুকতে পারে সে ব্যাপারে সবোর্চ্চ সতকর্তা রাখতে হবে। বড় বড় রাঘববোয়ালদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা জরুরি। এসব রাঘব বোয়ালরাই দেশের যুব সমাজের মধ্যে নেশার বীজ বুনছে।
অলোক আচাযর্্য: কলাম লেখক