শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ধারার পুনর্জন্ম

উন্নয়নের মহাসড়কে যে বাংলাদেশ ছুটে চলছে তার গতি ঠিক রেখে আরও বেগবান করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধারার পুনর্জন্ম হবে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে, ষোলো কোটি মানুষের মতো আমিও একথা বিশ্বাস করি।
মোনায়েম সরকার
  ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। একদিন এ দেশের হাতে ছিল পরাধীনতার হাতকড়া। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ছিল এই দেশ তথা বাংলার মানুষের ভাগ্যলিখন। নিজেদের অধিকার বুঝে পেতে বাংলার নিরীহ মানুষ শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। অনেক প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে তারা অর্জন করে প্রিয় স্বাধীনতা। বাংলার স্বাধীনতা বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বারবার দিকভ্রান্ত হয়েছে বাংলার স্বপ্নতরি। সেই ধারার বাইরে এনে যে মানুষটির মহান নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আজ মর্যাদার আসনে আসীন করেছে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জন্য কোনো প্রশংসাই আজ আর যথার্থ নয়। তিনি সব ধরনের প্রশংসার ঊর্ধ্বে। একটি নিমজ্জিত দেশকে, একটি অন্ধকার আচ্ছন্ন পতিত জাতিকে তিনি যেভাবে বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আসলেই বিরল।

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে শুরু থেকেই তৈরি হতে থাকে একের পর এক নাটক। এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি ধারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসীরা এক হতে থাকে ড. কামাল হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে।

শুরু থেকেই নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সারাদেশ মেতে ওঠে ভোটের উৎসবে। শেখ হাসিনার শাসনামলের পূর্বের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক বাংলাদেশ নয়। যারা এক বাংলাদেশ মনে করে তাদের দৃষ্টিতে কোনো নতুনত্ব খুঁজে পায় না বলেই এ দেশে এখনো স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি ভোটের মাঠে লড়াই করার সাহস পায়। অনেক সুশীলের ভাবখানা এমন ছিল যেন স্বাধীনতাবিরোধীরাই আবার ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মতো আমারও আস্থা ছিল জনতার প্রতি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলার মানুষ কখনোই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না। তারা ঠিকই শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। নিয়েছেও তাই। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম হয়েছে। আমি এই পুনর্জন্মপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে দুই একটি কথা বলতে চাই। কথাগুলো শুনতে কেমন লাগবে জানি না। তবে সবগুলো কথাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আমি কিশোর ছিলাম। সেই নির্বাচনের একটি ঘটনা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি তখন দেখেছিলাম বাংলার মানুষ কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচিত করেছিল। সেই সময় সাধারণ ভোটারের লাইনে এসে অকারণে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। ভোটাররা পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে পুকুরে পড়ে গেছে। পুকুর থেকে উঠে এসে ভেজা কাপড় নিয়ে আবার লাইনে দাঁড়িয়েছে তার পছন্দের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিয়ে জয়ী করার জন্য। ঘটনাটা বলা হলো এই কারণে যে, মানুষ যখন পরিবর্তনের জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে তখন কোনোভাবেই তাদের দমিত করে রাখা যায় না। নৌকার পক্ষে এবার যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এর সঙ্গে কেবল ৭০ সালের নির্বাচনেরই তুলনা হতে পারে। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়েছিল, শতাংশ হিসেবে ৮৯%। তখন মহিলারা সাধারণত ভোট কেন্দ্রে যেতেন না। মোট ভোট দেয় ৫৭ শতাংশ ছিল।

এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছিল সত্যিই তা অবিশ্বাস্য। বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ উন্নয়ন করেছে, দেশসেবা করেছে- বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছে নৌকাকে বিস্ময়করভাবে জয়ী করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা আখ্যা দিয়েছে 'ভোট-ডাকাতি' বলে। যারা বাংলাদেশের জন্মকে রোধ করতে চেয়েছে, যারা এখনও মেনে নেয় না বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-অস্তিত্বকে তাদের পক্ষে এ দেশের কোনো কিছুই সুন্দর নয়। তারা সব সুন্দরের ভেতর থেকেই খুঁত বের করার চেষ্টা করে। এবারও তাই করেছে। যে নির্বাচনকে ঘিরে এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দ, জনতার এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ- যে নির্বাচনকে দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে ঘোষণা করেছেন- কিভাবে সেই নির্বাচনকে ঘিরে ভোট-ডাকাতির বদনাম রটানো হলো তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। দেশবিরোধী শক্তিরা এখনো মনে করে ওরাই দেশ শাসন করবে। বাংলাদেশের সচেতন মানুষ ওদের ক্ষমতায় বসাবে। বাংলাদেশে এমন অসম্ভব ঘটনা ঘটা কি আদৌ সম্ভব? একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা এ দেশের মাটিতে আর কখনোই পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। এবারের গণরায়ে সেই বিষয়টিই নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে নির্বাচিত করে তরুণ ভোটাররা এই কাজটি খুব আগ্রহের সঙ্গে করেছে।

এবারের নির্বাচনে নিষ্প্রাণ বিএনপি অর্ধডজন আসন পাওয়ায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির ভাগ্যে একটি আসনও জোটার কথা নয়। অথচ তারা এতগুলো আসন কিভাবে পেল। আবার কেউ বলছেন, বিএনপিকে কমপক্ষে ৫০টি আসন দেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ ভাবখানা এমন, যেমন আসন দেওয়া-না দেওয়া সরকারের হাতে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাকে নির্বাচিত করবে সেই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে। গণরায়কে কমানো-বাড়ানো জনতার পক্ষেই সম্ভব, সরকারের পক্ষে নয়। সুতরাং সরকারকে মিথ্যা দোষারোপ করে কোনোই লাভ নেই। নিজেদের দোষ-ত্রম্নটি শুধরে আগামী নির্বাচনের জন্য তৈরি হওয়াই এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যার বা যাদের ঘাড়ে চড়ে বিএনপি নির্বাচনের বৈতরণি পার হতে চেয়েছিল তাদের কারো আমলনামাই ভালো নয়। এরা বেশির ভাগই পতিত আওয়ামী লীগার। পরিত্যক্ত আওয়ামী লীগারের কাঁধে চড়ে নির্বাচনের নদী পার হতে চেয়ে বিএনপি শুধু ভুল করেনি, তাদের রাজনীতি দেউলিয়া হয়ে গেছে। এরা যে অর্ধডজন আসন পেয়েছে- এটাই তো এই মুহূর্তে বিস্ময়কর ঘটনা। যারা আগুন-সন্ত্রাস করেছে, পেট্রোল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে- যারা নিরীহ মানুষের জনসভায় বোমা হামলা চালিয়েছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। জনগণ তাদের ভোট দেবে কেন? বিএনপির ২৮৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৬৩ জন প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন। তাদের সবারই জামানত হারানোর কথা ছিল। সেটা হলেই রচিত হতো নতুন ইতিহাস।

আমি এ প্রসঙ্গে ৫৪ সালের মুসলিম লীগ মন্ত্রী টি. আলীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- যার একটি ভোটের দাম পড়েছিল ৭৭০০ টাকা। তিনি ভেবেছিলেন বিজয়ী হবেন, পরে দেখা গেছে, তিনি জামানতও রক্ষা করতে পারেননি। নির্বাচনটা আসলে এমনই। জনগণ কখন কাকে কিভাবে নামাবে-ওঠাবে তা কেবল জনগণই জানে। এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের কথা বলা যেতে পারে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের ব্যাপারে শত ভাগ আশাবাদী ছিল, কিন্তু ভোটের ফলাফল ছিল ঠিক উল্টো। ভোটের মারপ্যাঁচে পড়ে নিশ্চিত জয়ও রূপান্তরিত হয় নিশ্চিত পরাজয়ে। এবারের এই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনেও এই ঘটনাটি ঘটেছে।

বিজয়ী আওয়ামী লীগকে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমি অভিবাদন জানাই। সেই সঙ্গে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- আপনার হাতেই এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বাংলার মানুষ ভালোবেসে আপনার হাতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির শাসনভার স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছে। এবার আপনি আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব অঙ্গীকার করেছেন সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন। দেশ থেকে দুর্নীতি বিদায় করতে যে যে পথ অনুসরণ করা দরকার আপনি সেসব পথই অনুসরণ করুন।

বাংলাদেশকে আপনি উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে যে স্বপ্ন বুনে চলেছেন সেই স্বপ্ন আপনার হাতে বাস্তবায়ন হোক এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। আওয়ামী লীগের এক সময় যারা প্রাণপুরুষ ছিলেন- যেমন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামানসহ অনেকেরই গাড়ি-বাড়ি ছিল না। কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল। এখন পরিস্থিতি বদলেছে নিশ্চয়ই, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থাকতেই হবে। ব্যবসায়ীদের দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখাই সঙ্গত হবে। ব্যবসায়ীরা কখনোই দলের দুঃসময়ে দলের পাশে থাকে না। দলছুট হাইব্রিড নেতারাও দুঃসময়ে দল থেকে কেটে পড়ে। সুতরাং আগামী দিনের প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভেবেচিন্তে গ্রহণ করতে হবে।

উন্নয়নের মহাসড়কে যে বাংলাদেশ ছুটে চলছে তার গতি ঠিক রেখে আরও বেগবান করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধারার পুনর্জন্ম হবে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে, ১৬ কোটি মানুষের মতো আমিও একথা বিশ্বাস করি।

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93421 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1