একজন নেতাকে বিভিন্ন সময় একেক ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়- যাদের মতামত ভিন্ন ধরনের। মানুষের মতামত একে অন্যের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে নেতাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয়। জনগণ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নানা মত প্রদান করে, কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। মানুষের ভিন্ন মত থাকা সত্ত্ব্বেও নেতাকে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নেতা তার আস্থা, দৃঢ়তা, বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে জনগণকে একই পস্ন্যাটফর্মের নিচে আনতে সক্ষম হন। জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে। নেতার সিদ্ধান্ত এবং নেতার মতামত অনুসরণ করে। জনগণকে একমন্ত্রে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে তা হলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। জনগণের মাঝে একটি সঠিক ব্যাপার সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। আবার একইভাবে একটি ক্ষতিকর ব্যাপার সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। একজন নেতা মানুষের এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে তাদের মঙ্গলের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করেন।
আমাদের বাঙালিদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার মাধ্যমে আজকের এই প্রজন্ম তাদের নিজ পরিচয় পেয়েছে, যার মাধ্যমে আজ আমরা পৃথিবীকে জানাতে পারি বাঙালি জাতি নামের একটি শক্তিশালী জাতি হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে- যার মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভের প্রয়োজন অনুভব করেছি এবং যার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে তা নিয়ে গর্ব করতে পারছি। আজ বাঙালি জাতিকে পৃথিবী সম্মান করে, স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলা ভাষাকে মর্যাদা প্রদান করে। স্বাধীনতার আগে গত এক হাজার বছরে (বাঙালিরা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়েছে প্রায় এক হাজার বছর আগে) বাঙালিরা যে পরাধীন, অবাঙালিদের হাতে নির্যাতিত এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে যে তারা বঞ্চিত তা নিয়ে কেউ কথা বলেনি বা উপলব্ধি করার ক্ষমতাও কারো ছিল না। মানুষের এ দৃষ্টিভঙ্গি তখনও হয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ এক হাজার বছর পর আমাদের মাঝে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। তিনি আমাদের উপলব্ধি করিয়েছেন আমরা বাঙালি এবং আমাদের অধিকার আমাদের এবার আদায় করে নিতে হবে। অবাঙালি জমিদার, মোগল, ব্রিটিশ আর শেষে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী একের পর এক বাঙালিদের অধীন করে রেখেছে। হই আমরা মুসলমান, হই আমরা হিন্দু, হই আমরা খ্রিষ্টান, হই আমরা বৌদ্ধ, হোক আমাদের গায়ের রং বাদামি আমাদের অবাঙালিরা সবসময় তাদের থেকে আলাদা করে রেখেছে, আমাদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে, আমাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বিশ্বাস করেছি এবং বন্ধু মনে করেছি কিন্তু আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছে যে, সবার কাছে জাতিগত পরিচয় অন্য সব পরিচয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান- যা এখনো সারা পৃথিবীতে সব জাতিগোষ্ঠী অনুসরণ করে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় ১৯৭১-এর ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের আগ পর্যন্ত বাঙালিদের মধ্যে এ উপলব্ধি জন্মায়নি। এ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাঝে এ উপলব্ধির জন্ম দিয়েছেন, আমাদের স্বাধীন দেশে নিজ পরিচয়ে বাঁচার জন্য লড়াই করেছেন এবং স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আর এ কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। বাঙালিরা সংগ্রাম করে বেঁচে আছে বহুবছর ধরে। বিভিন্ন জাতি বাঙালিদের শাসন করেছে। বাঙালিদের ব্যবহার করে উন্নত হয়েছে ওরা। ১৯৬৬ সালের ৬ দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের এই দুর্দশা লাঘবের প্রচেষ্টা শুরু করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করার পরও তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন আবারও বাঙালিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। তিনি এটাও বুঝতে পারেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের কখনই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে তুলে ধরেন বাঙালিদের দুর্দশার কথা, বাঙালিরা এ অন্যায় বৈষম্য আর সহ্য করবে না- যদি কি না তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে না দেয় এবং যদি দরকার হয় সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালিদের অধিকার বুঝে নিতে হবে। এ সংগ্রাম যেন বহুকাল ধরে চেপে রাখা বাঙালিদের দুঃখ, কষ্ট আর ক্ষোভের প্রতিফলন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করার বদলে ২৫ মার্চ রাতে নির্মম হত্যাকান্ড চালায়। যারা নিজের দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম হত্যাকান্ড চালাতে পারে তারা বাঙালিদের নিজের দেশের মানুষ হিসেবে গণ্য করে না তা সেদিন প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। তারা এ হত্যাকান্ড চালায় ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে। চালায় একইসঙ্গে নারী নির্যাতন ও লুটপাট। আজ আমাদের সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দ্বারা পরিচালিত। যার কারণে সব দিক দিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের দ্রম্নত অগ্রগতি ও উন্নয়ন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের উন্নয়নকে রোল মডেল বলে ঘোষণা করেছে। বহু দেশ আজ বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে চায়। আরো গর্বের কথা ইউনেসকো পহেলা বৈশাখে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। একুশে ফেব্রম্নয়ারি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। চিরস্থায়ী মন্দা ও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশ থেকে বাংলাদেশকে সব ধরনের দানা শস্য, সবজি ও মাছ-মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও উদ্বৃত্ত দেশে রূপান্তরিত করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। এখন বাংলাদেশের অতি উন্নতমানের ও সুস্বাদু মাছ-মাংস এবং শাকসবজি বিদেশে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে। তার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। এ সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়নে অসম্মতি জানালেও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশের নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছেন। উন্নয়নের দৃঢ় সংকল্প ছাড়া এ পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতো না। এ ছাড়াও শহরজুড়ে তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল- যা ঢাকার যানজট খুব শিগগিরই লাঘব করবে। বিদু্যতের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র। হাইওয়ে, রেলওয়ে দিয়ে মাকড়সার জালের মতো সারাদেশ ছেয়ে ফেলেছেন। সম্প্রতি চালু হয়ে গেল ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। বাণিজ্যে যোগাযোগ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পটুয়াখালী জেলায় নির্মাণ করেন পায়রা সমুদ্রবন্দর। ডিজিটাল টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে মুহূর্তে দেশের যে কোনো প্রান্তের সঙ্গে অন্য স্থান শুধু নয়, সারা বিশ্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যবস্থা সহজ করেছেন।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি করেছেন আগামী শত বছরের একটি পরিপ্রেক্ষিত ডেল্টা পরিকল্পনা। এসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাংলাদেশকে ২০৫০ সালের মধ্যে উচ্চতম আয়ের দেশে পরিণত করবে। এ সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়। বঙ্গবন্ধুর বহুমুখী প্রতিভাধর সুযোগ্য কন্যা মুজিববর্ষের অন্যতম লক্ষ্য ঠিক করেছেন বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করতে। এটা হলে ছয় স্থায়ী পরাশক্তির ছয় দাপ্তরিক ভাষার সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলা।
২২ শে মার্চ, ২০২০
নৃপ: তরুণ কথাশিল্পী