বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস : সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা ও করণীয় কল্পচিত্র

আমার প্রস্তাবিত 'মানুষ বাঁচাও' কল্পচিত্র কর্মসূচিতে আরও দু'একটা বিষয় বলে রাখা জরুরি। দেশের কৃষি খাতকে সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য খাত হিসেবে বিবেচনা করে তদনুযায়ী যতদিন করোনাভাইরাস ও তার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে আমরা মুক্ত না হচ্ছি ততদিন কৃষি খাতে সব ধরনের উৎপাদন প্রণোদনা থেকে শুরু করে ঋণ মওকুফ, ক্ষুদ্র ঋণের সুদ মওকুফ, স্বল্প সুদে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে বিনা সুদে কৃষিঋণ প্রদানসহ কৃষকের সক্ষমতা বৃদ্ধির সব কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে চালু রাখতে হবে।
আবুল বারকাত
  ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

খোলা চোখে অদৃশ্যমান আকার-আয়তনে এত ক্ষুদ্র একটা জিনিস যে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকে এতটা দৃশ্যমান অসহায় করতে পারে তার চাক্ষুস প্রমাণ করোনাভাইরাস-১৯ বা কোভিড-১৯। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আমার মতো সামাজিক বিজ্ঞানীর পক্ষে মন্তব্য করা ধৃষ্টতা এবং তা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত নাও হতে পারে। আর সে কারণেই করোনাভাইরাস-১৯ সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণাটা বলে রাখা প্রয়োজন। ধারণাটা এরকম : আমাদের দেহে রোগ-প্রতিরোধ করার জন্য একটা সিস্টেম আছে যাকে বলা হয় ইমিউন সিস্টেম। এ সিস্টেমকে তুলনা করা চলে বিশাল এক সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। এ বাহিনীর কাজ হলো হয় কোনো শত্রম্নকে শরীরে ঢুকতে না দেয়া অথবা ঢুকলেও তাকে বাড়াবাড়ি করতে না দেয়া, ক্ষতি করতে না দেয়া, অথবা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। কিন্তু করোনাভাইরাস এক মহাধড়িবাজ শত্রম্ন যে অতি সন্তর্পণে ফাঁকি দিয়ে বন্ধুবেশে আমাদের দেহে অনুপ্রবেশ করে- মুখ, নাক, চোখ দিয়ে। করোনার চারপাশে একটা দেয়াল বা পোশাক আছে। পোশাক পরা অবস্থায় সে যথেষ্ট ভদ্রলোক। ধড়িবাজ এ ভদ্রলোকটি আশ্রয় নেয় আমাদের দেহের কোষে। থাকে সুযোগের অপেক্ষায় কখন সে আমাদের দেহকোষে ঢুকে তার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সুইচ অন করবে। এ প্রক্রিয়ায় সুযোগ পাওয়া মাত্রই একসময় তার পোশাকের মধ্যে যে আরএনএ ভাইরাস আছে তা বিস্তারের জন্য সে সুইচ অন করে। তখনই চালু হয়ে যায় ধড়িবাজ করোনাভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি। একপর্যায়ে সংখ্যা এতই বাড়ে যে আক্রান্ত কোষগুলো ভাইরাসকে ধারণ করার ক্ষমতা অতিক্রম করে এবং কোষটি ফেটে যায়। এভাবে এক একটা করোনাভাইরাস থেকে তৈরি হয় লক্ষ লক্ষ করোনাভাইরাস। আর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দ্রম্নত জন্ম নেয় কোটি কোটি কোটি করোনাভাইরাস এবং আক্রমণ করে সে আমাদের শ্বাসতন্ত্রকে। একপর্যায়ে শ্বাসতন্ত্র তার স্বাভাবিক কর্মকান্ড করতে অক্ষম হয়ে যায়; বিকল হতে থাকে শ্বাসতন্ত্রের পুরো যন্ত্রটি। এরপর হয় অসুস্থতা আর শ্বাসতন্ত্র দুর্বল হলে আশঙ্কা থাকে মৃতু্যর।

বিজ্ঞানীরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত-সম্ভাব্যদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভ্যাকসিন আবিষ্কার, চিকিৎসা, আক্রান্ত-সম্ভাবনা কমিয়ে আনা, বিস্তার রোধ, উৎপত্তির কারণ, ভাইরাস বিস্তার রোধের পথ-পন্থা উদ্ঘাটন থেকে শুরু করে ক্ষতি হ্রাস কৌশল নিয়ে দিবানিশি কাজ করছেন। সিরিয়াস সমাজচিন্তক বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন 'করোনাভাইরাস-১৯' হলো 'আত্মতুষ্ট সভ্যতার প্রতি প্রকৃতির ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান'। কথাটি বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবেন। কিন্তু যেটা দিবালোকের মতো সত্য, সার্বজনীন সত্য, নিরঙ্কুশ সত্য তা হলো এ ভাইরাস আমাদের জন্য সাধারণ কোনো ঝুঁকি বা রিস্কের কারণ নয়- এ ভাইরাস আমাদের জন্য, বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য নিরঙ্কুশ অনিশ্চয়তা বা আনসাইর্টেনিটির কারণ। কারণ যদি শুধু ঝুঁকি হতো তাহলে আমরা ঝুঁকির বিভিন্ন দিক পরিমাপ করতে পারতাম এবং সে মাফিক সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু অনিশ্চয়তা তো মাপজোক করা যায় না; আর তাই অনিশ্চয়তার বিভিন্ন দিক মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত পথ-পদ্ধতি বাতলানোও সম্ভব নয়ু এসব নিয়ে পরীক্ষিত কোনো তত্ত্বও নেই। তবে আমার মতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এক বা একাধিক সিনারিও বা কল্পচিত্র বিনির্মাণ করে প্রতিটির বিপরীতে সম্ভাব্য সমাধান চিত্র আঁকতে হবে। এ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় এ ক্ষেত্রে যে তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে তা হলো শক্তিশালী 'সাধারণ জ্ঞান' বা কমনসেন্স। তবে বলে রাখি এ ধরনের কমনসেন্স যথেষ্ট আনকমন। আর বিষয়টা যখন বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস-১৯ তখন তা আরও অনেকগুণ বেশি প্রযোজ্য। এটাও সত্য, খন্ড চিত্র পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়- আবার খন্ড চিত্রনির্ভর উপসংহার হতে পারে যথেষ্ট মাত্রায় বিভ্রান্তিকর অর্থাৎ বিষয়টিকে সামগ্রিক তার নিরিখে দেখতে না পারলে সমাধানের কল্পচিত্রও হবে খন্ডিত। এটাও বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা।

করোনাভাইরাস-উদ্ভূত অনিশ্চয়তা এবং সমাধানের লক্ষ্যে উত্থাপিত কল্পচিত্রটি সম্পূর্ণভাবে আমার নিজস্ব ভাবনা। কোনো প্রমাণিত তত্ত্ব অথবা প্রাক-অভিজ্ঞতা উদ্ভূত নয়। তবে সমাধান-উদ্দিষ্ট ভাবনার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি আছে যা পরে বলেছি।

আমার মূল বক্তব্যটি এরকম : বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে হবে এবং তা সম্ভব; ক্ষতি-সম্ভাবনা হয়তো বা অপরিমেয় কিন্তু ক্ষতি হ্রাস করতে হবে এবং সেটাও সম্ভব।

কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে এখন পর্যন্ত ভাইরাস-আক্রান্ত রোগী নির্ণয় বা ডিটেকশন, সঙ্গরোধ বা কোয়ারেন্টিন, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিধি মেনে চলা, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, ব্যক্তিপর্যায় থেকে সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস শ্রম- আর এসবের পাশাপাশি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা ও চিকিৎসা সহায়তা, সম্মিলিতভাবে এসবই একদিকে যেমন দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এবং অবস্থান-ঠিকানা সম্পর্কে সঠিক তথ্যচিত্র দেবে তেমনি তা করতে পারলে এমন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে যার ফলে রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে অথবা বিস্তার-গতি কমবে। অর্থাৎ বিস্তারের ঊর্ধ্বমুখী গতিপথ নিঃসন্দেহে নিম্নমুখী হবে।

একটি বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কোনো দ্বিমত নেই, যে কোনোভাবেই হোক না কেন আক্রান্ত মানুষের নিরঙ্কুশ সংখ্যাকে কমিয়ে আনতে হবে। আসলে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাটা কত হলে 'কম' বলা যাবে তা নিয়ে মতানৈক্য স্বাভাবিক। কারণ প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০ জন আক্রান্ত হলে রোগতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আক্রান্ত 'কম' নাকি 'সহনীয়' নাকি 'বেশি'? সম্ভবত রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এ প্রশ্নের সম্ভাব্য সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম। তবে আমাদের মতো আমজনতা যুক্তি দেখাতে পারে যে ওইসব 'কম', 'সহনীয়', 'বেশি' নির্ভর করতে পারে জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর। অর্থাৎ ঢাকার ছোট একটা বস্তিতে যেখানে মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করেন সেখানে ওই সংখ্যাটি 'বেশি'। আর যেখানে এক লাখ মানুষ দশ বর্গকিলোমিটারে মোটামুটি সমান দূরত্বে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছেন সে ক্ষেত্রে ওই একই সংখ্যাটি 'কম' বলে বিবেচিত হলেও হতে পারে। আর তাই যদি হয় তাহলে আমরা বলতে পারব কোথায় কতটুকু জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে এ কথাও বলতে পারব যে একই দেশের মধ্যে মানুষ চলাচলে কোথাও কোথাও একধরনের বর্ডার বা বেড়াজাল বানাতে হবেুঅস্থায়ীভাবে হলেও। আর যদি ওই বিস্তারের সঙ্গে 'কম', 'সহনীয়', 'বেশি'র কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে জোর দিতে হবে সর্বত্র। সে ক্ষেত্রে সম্পদও সে অনুযায়ী বেশি লাগবে। এসব নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মত হলো 'কম-সহনীয়-বেশি'- এসব বিবেচনা যতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তার চেয়ে বহুশতগুণ গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগের বিস্তার রোধ করতে হবে এবং বিস্তার-গতি কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন হবে আত্মঘাতী।

আগেই বলেছি সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা হতে হবে সম্মিলিত উদ্যোগে। তবে বিষয়টি যেহেতু মহামারি সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা সেহেতু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আর সে ক্ষেত্রে প্রচলিত গতানুগতিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অথবা অসমন্বিত ব্যবস্থাপনা অথবা বহু অনভিপ্রেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংবলিত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের ফল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কার্যকর হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন কঠোর ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণ করা- যা প্রচলিত গতানুগতিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

কঠোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মত হলো- পৃথিবীর অন্যান্য সফল দেশের মতো আমাদের দেশেও কোভিড-১৯ প্রতিরোধের জন্য মূল দায়িত্ব দিতে হবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন জ্ঞানসমৃদ্ধ দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে যিনি জনগণের পক্ষে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি হবেন আর অন্যসব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ-দপ্তর-অধিদপ্তর থাকবে একক দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তির অধীন এবং সম্পূর্ণ কার্যক্রম সুচারুরূপে সমন্বয় ও পরিচালনের জন্য তিনি জরুরি অবস্থা বা ইমারজেন্সি বিবেচনায় প্রয়োজনে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা-জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট সবার নিঃশর্ত সর্বাত্মক সহায়তা নেবেন। এ যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী হবেন চিফ অব কমান্ড আর একক দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্মানিত ব্যক্তিটি হবেন চিফ অব অপারেশনস। এর কোনো বিকল্প নেই।

করোনাভাইরাস-১৯ প্রতিরোধে এই ১ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ফল হবে বহুমুখী পজিটিভ-স্বল্প ও দীর্ঘ উভয় মেয়াদেই। স্বল্পমেয়াদে আক্রান্ত মানুষ বাঁচবে, সংক্রমণ হার কমবে, সংক্রমণ বিস্তার রোধ হবে, কমিউনিটিতে ছড়িয়ে যাওয়া কমবে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে, মানুষের মানসিক দুশ্চিন্তা উদ্ভূত দুর্দশা কমবে, কো-মর্বিডিটি (সহ অসুস্থতা) কমবে একই সঙ্গে কমবে সংশ্লিষ্ট মৃতু্য হার। আর দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে অনেক সুদূরপ্রসারী : ভাইরাস প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। সমগ্র স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ গেস্নাবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী আমাদের অবস্থান বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১১৩তম, যেখানে রোগ প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট সূচক জীবাণু বাহিত অসুখ-বিসুখ, বায়ো-সিকিউরিটি, বায়ো-সেফটি, জীবাণু কন্ট্রোল প্রাকটিস ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্য সিস্টেম,র্ যাপিড রেসপনস, রোগ নির্ণয় ও রিপোর্টিং- এসব সূচকে আমাদের অবস্থান বেশ তলার দিকে। ১ লাখ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে উন্নততর করবে যার অভিঘাত হবে কল্পনাতীত পজিটিভ এবং বংশপরম্পরা। নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বলয় দৃঢ়তর হওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জনস্বাস্থ্যসহ অর্থনৈতিক-সামাজিক বলয় সুসংহত হবে; দৃঢ়তর হবে সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যা সুশাসনের পূর্বশর্ত; দুর্বল প্রতিষ্ঠান সবল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে যা টেকসই প্রবৃদ্ধি ও প্রগতি নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যের জন্য এ বিনিয়োগ হবে উপরি পাওনা অর্থাৎ তখন তাদের এ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন পড়বে না শুধু রক্ষণাবেক্ষণসহ প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে হবে। এ বিনিয়োগ সুস্থ মানবসমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি সুপ্রশস্থ করবে যা ভবিষ্যতে জনসমৃদ্ধি ও মানবকুশলতা নিশ্চিত করবে। এক কথায় এ হলো সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানের আবশ্যিক বিনিয়োগ।

এ এক সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষাবস্থা। পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো ক্ষুধার্ত-অভুক্ত-অর্ধভুক্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের হাতে অর্থ থাকুক বা না থাকুক তাদের চুলায় নিম্নতম প্রয়োজনমতো খাবার থাকতেই হবে। সরকারি পরিসংখ্যানুযায়ী এসব মানুষের সংখ্যা ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ৩ কোটি ৪০ লাখ অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন 'দিন আনে দিন খায়' মানুষের কাজ থাকবে না তখন এসব মানুষের সংখ্যাটা দাঁড়াবে আনুমানিক ৬ কোটি। অর্থাৎ এরা হলেন- দেশের মোট খানার আনুমানিক ৩৭ শতাংশ। এই ৬ কোটি মানুষ বাস করেন আনুমানিক ১ কোটি ৫০ লাখ খানায়। যার মধ্যে গ্রামে ১ কোটি খানা আর শহরে ৫০ লাখ খানা।

যদি করোনাভাইরাস-১৯ অপ্রতিরোধ্যভাবে চলতে থাকে এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হয় তাহলে মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে খাবার সরবরাহ সম্ভব হবে না। আসা যাক কিছু হিসেবের কথায়। মূল কথা হলো- এসব দুর্দশাগ্রস্ত অভুক্ত প্রতিটি মানুষকে খাদ্যবাবদ দৈনিক কমপক্ষে গড়ে ৭৫ টাকা বরাদ্দ করতে হবে (হিসেবটি করা হয়েছে খানাভিত্তিক আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর দারিদ্র্যের নিম্নরেখার সঙ্গে মূল্যস্ফিতি যোগ করে)। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন সারা দেশে লাগবে ৪৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ মাসে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী ছয় মাস চালাতে হলে লাগবে ৮১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য অনিশ্চিত এ অবস্থা পরিবর্তিত হলে অথবা নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে এ অঙ্ক কম-বেশি হতে পারে। উলেস্নখ্য, যেখানে শিল্প মালিকদের জন্য আপাতত ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন আর্থিক ও নীতি সুবিধাসহ আরও অনেক সুবিধে দিতে হবে সেখানে দুর্দশাগ্রস্ত অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষ বাঁচাতে তাদের মধ্যে খাদ্যবাবদ ছয় মাসের জন্য ৮১ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ যে কোনো বিবেচনায় ন্যায্য বরাদ্দ। আবার ওই বরাদ্দ ফল কিন্তু পরবর্তীকালে পুঁজির মালিকরাই আনুপাতিক বেশি হারে ফেরত পাবেন কারণ তাদের দরকার হবে সুস্থ শ্রমিক। আর ওই সুস্থ শ্রমিকরাই দেশজ উৎপাদন বাড়াবেন এবং একই সঙ্গে সত্যিকার অর্থে সুস্থ থাকলে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে- বাড়বে প্রবৃদ্ধি। শেষ বিচারে আনুপাতিক হারে এ সবের বেশি অংশের ফল ভোগ করবেন পুঁজির মালিক ও তাদের স্বার্থবাহিরা।

সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষাবস্থা এড়াতে জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিয়ে দুটো বিষয় নির্ধারণ জরুরি। প্রথমত, যেসব খানা খাদ্য বরাদ্দপ্রাপ্তি যোগ্য তাদের তালিকা প্রণয়ন; দ্বিতীয়ত, তালিকাভুক্ত খানার মধ্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সে ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাস্ত না করা। দুটো কাজই গুরুত্বপূর্ণ এবং হতে হবে তুলনামূলক অভিযোগবিহীন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এখনই। তালিকা প্রস্তুতের নীতিমালা হতে হবে জনগণের কাছে সহজবোধ্য, গ্রহণযোগ্য এবং সময় নির্ধারিত। তবে এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মত হলো- গ্রাম এবং শহরে যেসব খানা নারীপ্রধান যার প্রায় শতভাগই আর্থিকভাবে দুর্বল ও ভঙ্গুর তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তালিকাভুক্ত হবেন (তবে কেউ সংগত কারণে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না চাইলে তাকে বাদ দেয়া উচিত), তালিকাভুক্ত হবেন সরকারি হিসেবের সব দরিদ্র খানা, সে সব খানা যাদের কোনো সদস্য মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে পারেননি অথবা পারছেন না, এবং সে সব খানা যাদের নিজস্ব মালিকানায় কোনো আবাসন নেই এবং গৃহহীন খানা, শহরের বস্তিবাসী এবং ভাসমান মানুষ, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের সংশ্লিষ্ট অংশ, করোনা আক্রান্ত অথবা সম্ভাব্য আক্রান্ত সব দরিদ্র খানা, চর-হাওড়-বাঁওড়ের মানুষ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ এবং যারা ইতোমধ্যে বয়স্কভাতাসহ অন্যান্য ভাতাদি পাচ্ছেন তাদের বাদ না দেয়া। এ তালিকা প্রণয়নে দল-মত-গোষ্ঠী-সমাজ যেন কোনোভাবে প্রভাব না ফেলতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ তালিকা প্রণয়নে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। তালিকাটি গ্রামে গ্রামে এবং শহর অঞ্চলে দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে দিতে হবে, মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দিতে হবে, এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। যোগ্য কেউ বাদ পড়লে প্রয়োজনে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ তালিকা প্রণয়নে কালক্ষেপণ ও গাফিলতি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং শাস্তির বিধান থাকতে হবে। .

এর পরের প্রশ্ন- তালিকাভুক্ত মানুষের কাছে বরাদ্দকৃত অর্থ অথবা খাবার কীভাবে পৌঁছাবে? বরাদ্দকৃত অর্থ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং অথবা প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে যে একই খানার জন্য যেন শুধু একটি (একাধিক নয়) মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে আমাদের দেশে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও ফলপ্রদ সরকারি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী অথবা সামাজিক সেফটি নেট কর্মসূচির মাধ্যমে যে শতাধিক ধরনের বরাদ্দ মানুষের কাছে পৌঁছায় সেটা অনুসরণ করা যেতে পারে। খাদ্যের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অথবা বরাদ্দকৃত খাদ্য সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিলি-বণ্টন ও মনিটরিং ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশ নেবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট জনগণের সেবা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের নারী-পুরুষ প্রতিনিধি, সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা ও আইনি সংস্থার প্রতিনিধিরা। কেন্দ্রীয়ভাবে রিপোর্ট যাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে যিনি প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সরাসরি রিপোর্ট করবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অর্থাৎ খাদ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও চিফ অব কমান্ড হবেন প্রধানমন্ত্রী আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্মানিত ব্যক্তিটি হবেন চিফ অব অপারেশন্স। অর্থাৎ সমগ্র মেকানিজম হবে মোটামুটি 'করোনাভাইরাস-১৯ প্রতিরোধ' কার্যক্রম যে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক একই ধরনের গুরুত্ব দিয়ে।

এখন প্রশ্ন অভুক্ত-অর্ধভুক্ত-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ বাঁচাতে ছয় মাসের খাদ্য-সহায়তা বাবদ যে ৮১ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ লাগবে তা কোথা থেকে আসবে? এ প্রশ্নের পাটিগাণিতিক উত্তর তেমন কঠিন নয়।

আমার প্রস্তাবিত 'মানুষ বাঁচাও' কল্পচিত্র কর্মসূচিতে আরও দু'একটা বিষয় বলে রাখা জরুরি। দেশের কৃষি খাতকে সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য খাত হিসেবে বিবেচনা করে তদনুযায়ী যতদিন করোনাভাইরাস ও তার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে আমরা মুক্ত না হচ্ছি ততদিন কৃষি খাতে সব ধরনের উৎপাদন প্রণোদনা থেকে শুরু করে ঋণ মওকুফ, ক্ষুদ্র ঋণের সুদ মওকুফ, স্বল্প সুদে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে বিনা সুদে কৃষিঋণ প্রদানসহ কৃষকের সক্ষমতা বৃদ্ধির সব কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে চালু রাখতে হবে।

আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন কর্মসূচি ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে। আগামী বাজেটে করোনাভাইরাস-১৯ এর ঘাত-প্রতিঘাতসহ সংশ্লিষ্ট 'মানুষ বাঁচাও' কর্মসূচির অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাজেটের প্রচলিত-গতানুগতিক কাঠামো পরিবর্তিত হবে। অর্থনীতি আবারও জেগে উঠবে কিন্তু ভঙ্গুর হয়ে পড়বে অনেক খাত-ক্ষেত্র-শিল্প-ব্যবসা।

আমার আপাত শেষ কথা : করোনাভাইরাস-১৯ প্রতিরোধে 'মানুষ বাঁচাও' কর্মসূচির যে কল্পচিত্র প্রস্তাব করেছি তা যথেষ্ট মাত্রায় যৌক্তিক। কারণ একদিকে যেমন মানুষকে ভাইরাস থেকে প্রতিরোধ করতে হবে তেমনি অন্যদিকে কোনোভাবেই দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করা যাবে না এবং অবস্থা স্বাভাবিক হলে উন্নয়নের চাকা দ্রম্নত ঘোরাতে হবে। আমরা এসব মোকাবিলায় সক্ষম। কারণ আমাদের নেতৃত্বের শিখরের ব্যক্তিটির মানবিক দায়বোধ সম্পর্কে কারও সন্দেহ নেই। আর এসব মোকাবিলা করতে সক্ষম হলে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশের সমন্বয়-প্রভাব বা স্পিল ওভার ইফেক্ট হবে উচ্চ মাত্রায় ধনাত্মক; শ্রম ও পুুঁজির বাইরে উন্নয়নে আরও যে সব উপাদান কাজ করে তার প্রভাব হবে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন মোট উপকরণ উৎপাদনশীলতা; মোট দেশজ উৎপাদনের ভাবনাজগতে নির্ধারক স্থান করে নেবে মানুষের জীবন-সমৃদ্ধি অথবা জীবন-কুশলতা; অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি ফ্যাক্টরের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাক্টর বেশি প্রভাব ফেলে- আমরা সেদিকেই এগোবো; এবং সর্বশেষ কথা আমাদের দেশে বহু প্রতিষ্ঠান আছে যা প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত হয়নি সে সব গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসংবলিত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে ফলে সুশাসন নিশ্চিত হবে, নিশ্চিত হবে শুধু জবাবদিহিতা নয়- মানবিক দায়বদ্ধতা। শেষ বিচারে আমরা অবশ্যই পারব এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি বিনির্মাণ করতে যা 'আত্মতুষ্ট সভ্যতার প্রতি প্রকৃতির ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান'-এ দ্রম্নত সাড়া দিতে সক্ষম, যা সম্ভাব্য দ্রম্নততার সঙ্গে 'ডিজিটাল যুগে মহামারি-উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকট' কাটিয়ে উঠতে সক্ষম, এবং যা শেষ বিচারে প্রকৃতির প্রতি আস্থা-সম্মান রেখে মানুষের জীবন-সমৃদ্ধি ও জীবন-কুশলতা বাড়াতে সক্ষম।

আবুল বারকাত: অধ্যাপক, অর্থনীতি ও জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

নধৎশধঃধনঁষ৭১@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95354 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1