শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

কোরআনের সুরে মুখরিত রমজান

নতুনধারা
  ১৯ মে ২০২০, ০০:০০

পবিত্রতা অর্জন ও আলস্নাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের রোজার এবং কোরআনের কোনো তুলনা হয় না। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের বড় কারণ, এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ পবিত্র আল-কোরআন নাজিল হয়। আলস্নাহপাক বলেছেন, 'রমজান সেই মাস যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআন, যা মানুষের হেদায়েত, সত্যের পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশক আর ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে।' এ মাসেই এমন একটি রাত রয়েছে যাকে বলা হয় লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী। আলস্নাহপাক এ সম্পর্কে বলেছেন, 'আমরা এটি (আল-কোরআন) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষাও অধিক উত্তম'। বছরে বারোটি মাস। কিন্তু আল-কোরআনে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসের নাম উলেস্নখ করা হয়নি। শুধু রমজান মাসের নাম উলেস্নখ রয়েছে। কোরআনের বাণী, 'রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে' (বাকারা : ১৮৫)। এ কোরআন নাজিলের কারণে এ মাসের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফজিলত ও মাহাত্ম্যও বেড়ে গেছে বহুগুণে। পবিত্র কোরআন হলো জিব্রাইলের (আ.) মাধ্যমে আলস্নাহর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদের (স.) ওপর অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এটি ইসলামী জীবন দর্শনের মূল উৎস। এতে আছে মানুষের জীবন চলার যাবতীয় প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি, নির্দেশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক তথ্য। কোরআন মানবরচিত কোনো গ্রন্থ নয়। এর রচয়িতা ও রূপকার গোটা বিশ্ব জাহানের অধিপতি মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামিন। আর তিনি নিজেই এ কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। আর পবিত্র কোরআন এখনো যেমন আছে, দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত তেমনই অবিকল, অবিকৃত থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার সাহস কেউ করতে পারবে না। আব্দুলস্নাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (স.) আমাকে বললেন, 'আমাকে কোরআন শোনাও'। ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, আমি বললাম, কীভাবে আপনাকে কোরআন শোনাবো? কোরআন তো আপনার ওপরই নাজিল হয়েছে। এটা কত বড় বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ! কেমন আদবের সঙ্গে জবাব, কীভাবে আপনাকে কোরআন শোনাবো? আমি তো কোরআন আপনার থেকেই শিখেছি। রাসুল (স.) ইরশাদ করলেন, 'তুমি আমাকে কোরআন শোনাও, অন্যদের থেকে কোরআন শুনতে আমার মন চায়'। ইবনে মাসউদ (রা.) কোরআন তেলাওয়াত করতে লাগলেন, রাসুল (স.) নীরবে শুনছিলেন। যখন তিনি সুরায়ে নিসার ৪১নং আয়াতে পৌঁছলেন, অর্থাৎ, 'সেদিন কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মতের সাক্ষী এনে হাজির করব এবং সেদিন এদের সবার কাছে সাক্ষী হিসেবে আপনাকে নিয়ে আসব' তখন রাসুল (স.) ইরশাদ করলেন- থামো! ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন- আমি তাকিয়ে দেখলাম রাসুলের (স.) চোখ থেকে ঝরে পড়ছে অশ্রম্নর ধারা (বুখারি : ৪৫৮২)। বন্ধুর কথায় বন্ধু উদ্বেলিত হয়ে গেছেন। কালাম শুনে সেই সাহেবে কালামের কথা মনে হয়েছে যিনি কালাম নাজিল করেছেন। রমজানে যেহেতু প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাই এ মাসে যথাসাধ্য বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা প্রত্যেক মুসলিম ও মুমিনের ওপর আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেছেন, 'রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে' (মুসনাদে আহমাদ : ৬৬২৬)। রমজান মাসে রোজা ও তারাবির পর আলস্নাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত। এ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আলস্নাহর নৈকট্য লাভ করা সবচেয়ে সহজ। রাসূলুলস্নাহ (স.) রমজানে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এ থেকে বোঝা যায়, এ মাসে কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। তাই এ মাসে কোরআনের চর্চা আমাদের মধ্যে তাকওয়া তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য একনিষ্ঠভাবে, আদবের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াতের অন্য কোনো আমলের তুলনা হয় না। কোরআন তেলাওয়াতে হৃদয়ে তাকওয়ার সৃষ্টি হয়, মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়। ফলে আলস্নাহতায়ালার ইবাদতে অনেক বেশি আগ্রহ জন্মায় এবং আমল করা সম্ভব হয়। তবে যারা জীবনে কোরআন নামক গ্রন্থটি কখনও হাতে নেননি এবং তেলাওয়াতেও অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এবং যারা তেলাওয়াত করতে জানেন তবে শুদ্ধভাবে জানেন না তাদের জন্য এ মাসটি খুবই কার্যকর। পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে, মাদ্রাসা কিংবা মসজিদে কোরআন চর্চার রমজানিক বিশেষ প্রশিক্ষণ চলে থাকে। অবশ্য বর্তমানে সারা বছরই সহজ নূরানি পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে সহি-শুদ্ধভাবে কোরআন শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকেও শিখে নেওয়া যায়। তবে কোরআন নাজিলের মাসে কোরআন চর্চার চেয়ে উত্তম কাজ আর কিছু হতে পারে না। নিছক বরকত লাভের জন্যও এ মাসে কোরআনের বেশি বেশি চর্চা হওয়া দরকার। রমজানে কাজের শিডিউল পরিবর্তন, বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ থাকায় শুদ্ধ করে কোরআন চর্চার একটা মোক্ষম সুযোগ রয়েছে। যারা তেলাওয়াত জানেন এবং করেন তাদের জন্য অর্থ ও মর্ম উপলব্ধির মাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াত করে নিজের জীবনকে কোরআনের রঙে রাঙিয়ে ফেলুন। এ জন্য তারাবি, তাহাজ্জত ও দিনের যেকোনো সময় বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করে আলস্নাহর নৈকট্য লাভের বিকল্প নেই। রোজা এবং কোরআন মুসলিম মিলস্নাতের জন্য আলস্নাহ পাকের দেয়া অনন্য নেয়ামত। এই নেয়ামত রোজ কিয়ামতে রোজাদারদের জন্য শাফায়াত করবে। এ প্রসঙ্গে আব্দুলস্নাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুলস্নাহ (স.) ইরশাদ করেছেন : রোজা ও কোরআন রোজাদার বান্দাহর জন্য আলস্নাহ পাকের দরবারে শাফায়াত করবে। রোজা ফরিয়াদ করবে হে আলস্নাহ। আমিই এই বান্দাহকে রোজার দিনগুলোতে পানাহার ও কামাচার প্রভৃতি চরিতার্য করা হবে দূরে সরিয়ে রেখেছি। সুতরাং তুমি এই বান্দাহর জন্য আমার শাফায়াত কবুল করো। আর কোরয়ানুল কারিম ফরিয়াদ জানাবে, হে আলস্নাহ! আমিই এই বান্দাহকে রাত্রিকালে সুখ-নিদ্রামগ্ন থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, এই বান্দাহর জন্য আমার শাফায়াত মঞ্জুর করো। (রাসুল (সা.) বলেন, তারপর এই দুটি জিনিসের শাফায়াত কবুল করা হবে (বায়হাকি: শুআবুল ইমান)।

এই হাদিস থেকে স্পষ্টতই জানা গেল, যারা ইমান ও ইহতেসাবসহ মাহে রমজানের রোজা পালন করবে, রোজা কিয়ামতের দিন তাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য মহান আলস্নাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাবে। রোজা শুধু আলস্নাহ পাকের রেজামন্দি ও খোশনুদি অর্জনের লক্ষ্যেই পালন করা হয়। এবং রোজা আলস্নাহ পাকেরই ফরজ করা অনুষ্ঠান। পৃথিবীতে রোজার কোনো দৈহিক অস্তিত্ব পরিলক্ষিত না হলেও কিয়ামতের দিন শরীরী রূপ ধারণ করবে এবং রোজাদারের জন্য সুপারিশ করবে। এই সুপারিশ মহান আলস্নাহর দরবারে অবশ্যই কবুল হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি রোজার রাতগুলোতে কোরয়ানুল কারিম তেলাওয়াত করবে, অন্যের তেলাওয়াত মনোযোগসহকারে শ্রবণ করবে, কোরআনের মহব্বতেই রাতের সুখ-নিদ্রা পরিহার করবে, আল-কোরআন সশরীরে আলস্নাহর দরবারে তার জন্য সুপারিশ করবে। কোরআন আলস্নাহর নিজের কালাম, এই কালামে পাকের সুপারিশ কোনোক্রমেই আলস্নাহ পাক প্রত্যাখ্যান করবেন না। ইবনে আবি হাতেম তার তাফসিরে বর্ণনা করেছেন, রাসুলে (স.) কখনো কখনো আনসারি সাহাবিদের ঘরের তেলাওয়াত শোনার জন্য রাতের বেলা বেরিয়ে পড়তেন। সাহাবাদের ঘরগুলোতো ছিল কোরআন দ্বারা আবাদকৃত। তারা রাতের সময়টি কাটাতেন কোরআনের সঙ্গে, কোরআনের ফিকিরে। আমাদের ঘরগুলোর মতো তাদের ঘর তখন অশ্লীল অনর্থক কথা-বার্তা, কুরুচিকর গান-বাদ্য, ঝগড়া-ফ্যাসাদের আখড়া ছিল না। তাদের রাতদিন সব আলস্নাহর জন্য ছিল। যে দিলে কোরআনের কোনো অংশ নেই তার বিরান ঘরের মতো। বিরান ঘরে সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড় বাসা বাঁধে। আর যে অন্তরে কোরআনের কোনো অংশ নেই সে অন্তরে গান-বাদ্য, অশ্লীলতা, মন্দ চিন্তা বাসা বাঁধে। এজন্য আমাদের উচিত সাধ্যানুযায়ী কোরআন থেকে কিছু কিছু অংশ মুখস্থ করা, যাতে আমরা আমাদের জীবন সাজাতে পারি, যা আমাদের আলস্নাহর নৈকট্যশীল বান্দায় পরিণত করতে পারে। কিয়ামতের দিবসে কোরআন হয়তো গ্রহণযোগ্য সুপারিশকারী হিসেবে আসবে, না হয় এমন সাক্ষী হিসেবে আসবে যে পাঠককে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা কোরআন পাঠ করো; কারণ, কোরআন কিয়ামতের দিবসে পাঠকের জন্য সাক্ষী হিসেবে আসবে' (মুসলিম : ৮০৪)। অন্যত্র ইরশাদ করেন- 'তোমরা কোরআন পাঠ করো। কেননা, কোরআনের একটি বর্ণ পাঠ করলে একটি নেকি হবে। আর একটি নেকি দশটি নেকির সমান হয়। আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মিম একটি বর্ণ। বরং আলিফ একটি বর্ণ, লাম একটি বর্ণ, মিম একটি বর্ণ' (তিরমিজি : ২৯১০, হাজেম : ১/৫৬৬, বায়হাকি : ১৮৩১)। রাসুল (স.) বলেন, জান্নাতে কোরআন হিফজকারীকে বলা হবে, 'তুমি কোরআনে কারিম পড়তে থাকো এবং চড়তে থাকো। আর ঠিক সেভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাকো, যেভাবে দুনিয়ায় পড়তে। কেননা, (জান্নাতের ভেতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে' (শুনানে তিরমিজি : ২৯১৪)। পবিত্র কোরআন লওহে মাহফুজ থেকে নিকটবর্তী আসমানে এই রমজান মাসেই নাজিল হয়েছিল। এই মাস কোরআন নাজিলের সম্মানে সম্মানিত। এ কারণেই রাসুল (স.) রমজান মাসে হযরত জিব্রাইলের (আ.) সঙ্গে কোরআনের পুনারাবৃত্তি করতেন। বেশি বেশি কো্‌রআন শুনতেন ও তেলাওয়াত করতেন। কোরআনে কারিমের মূল কাজ হলো মানুষকে সিরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখানো। কোরআন আমাদের দিলের নূর। অন্তরের রোগের চিকিৎসা। কোরআন আমাদের জীবন। কোরআন আমাদের সৌভাগ্য। কোরআন আমাদের মুক্তির সনদ। আমাদের রবের বিধান। তাই কোরআনের ছায়াতলে আমাদের জীবন কাটাতে হবে। আমাদের প্রত্যেককেই কোরআনের আজমত বুঝে জীবনকে সৌভাগ্যমন্ডিত করা ও নিজেদের জ্যোতির্ময় করে তোলা জরুরি।

মোহাম্মদ আবু নোমান

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<99943 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1