মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে থাকা ৮৫% রোগীর চিকিৎসাই বড় চ্যালেঞ্জ

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৪ জুন ২০২০, ০০:০০
করোনাভাইরাস

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে সরকারি-বেসরকারি অর্ধশতাধিক ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে ১৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও করোনায় আক্রান্ত আরও প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ এখন হোম কোয়ারেন্টিনে। যাদের বেশিরভাগের শরীরেই মৃদু করোনার উপসর্গ থাকলেও এদের মধ্য থেকে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যাও কম নয়। হাসপাতালে সিট না পাওয়া, সুষ্ঠু চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কা, হয়রানির ভীতি এবং সেখানে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিবারে উপযুক্ত সদস্য না থাকায় তারা অনেকে বাধ্য হয়ে বাসায় অবস্থান করছেন। সরকারিভাবে তাদের টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সিংহভাগ রোগীই সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় সব রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে টেলিমেডিসিনের যে লজিস্টিক সাপোর্ট রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ হাজার রোগীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব। এর চেয়ে বেশি রোগীকে টেলিমেডিসিন সেবা দিতে হলে সরকারকে এ সংশ্লিষ্ট জনবলসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। এ হিসাবে বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত অন্তত ৮৫ শতাংশ রোগীর চিকিৎসার জন্য রেফারেল কোনো চিকিৎসক নেই। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। ফলে তারা অনেকে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উচ্চ ফি দিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউবা পরিচিতি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে অফিস-আদালত, গণপরিবহণ ও সব ধরনের শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় করোনা সংক্রমণ উচ্চ হারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে এ পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের এখনই জোরাল পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃতু্যর হার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা জানান, ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তুতি, রোগী ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য বিষয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বাড়িতে থাকা করোনা রোগীরা কীভাবে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেন, প্রয়োজনে কখন ও কীভাবে হাসপাতালে যাবেন, জরুরি মুহূর্তে কোনো চিকিৎসকের তাৎক্ষণিক টেলিফোনিক সহযোগিতা পাবেন তা নিশ্চিত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ হাসপাতালের চেয়ে বাড়িতে ৫ গুণের বেশি করোনা রোগী রয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হসপিটালের (আইসিএমএইচ) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ডা. এম এ মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত যেসব রোগীর জ্বর, সামান্য কাশি, সামান্য গলাব্যথাসহ অন্যান্য মৃদু উপসর্গ রয়েছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া যাদের কোনো রকম লক্ষণ নেই, অথচ রোগ শনাক্ত হয়েছে তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে টেলিমেডিসিন সেবা থাকতে হবে। যারা সেবা দেবেন তাদের টেলিমেডিসিনের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে, করোনা চিকিৎসারও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও একই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর ৪০ শতাংশের শরীরেই মৃদু উপসর্গ থাকে। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে মাঝারি উপসর্গ থাকা কারও কারও এবং তীব্র উপসর্গ থাকা সবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। মৃদু উপসর্গ থাকা রোগীরা বাসাতেই টেলিমেডিসিন চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।

অথচ দেশে কত মানুষ মৃদু উপসর্গ নিয়ে ভুগছেন, তারা কে, কোথায় অবস্থান করছেন সরকারিভাবে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। এমনকি মৃদু উপসর্গ নিয়ে বাসায় চিকিৎসা নেওয়া রোগী সুস্থ হয়ে উঠলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা জানতে পারছে না। এ ধরনের কোনো রোগী মারা গেলেও সে তথ্য তাদের অজানা থাকছে। এছাড়া কোন রোগী বাসায় চিকিৎসা নেবেন আর কে হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন- এই সিদ্ধান্ত কে নেবে তা নিয়েও ঠেলাঠেলি রয়েছে।

১ জুন পর্যন্ত দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ৫৩৪ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ হাজার ৫৯৭ জন ও মারা গেছেন ৬৭২ জন। ঢাকা শহর এবং ঢাকা বিভাগসহ আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও আইসোলেশনে আছেন প্রায় ৮ হাজার রোগী। অর্থাৎ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ৩০ হাজার রোগী।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা যখন ২০ হাজারের নিচে ছিল তখন পর্যন্ত তারা বাড়িতে থাকা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী টেলিমেডিসিন সেবার আওতায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দ্রম্নত বাড়তে থাকায় তারা এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। টেলিমেডিসিন সেবার পরিধি পরবর্তীতে যতটা বাড়ানো হয়েছে নতুন করে ১৫ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। অথচ রোগী বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এ অবস্থায় বাড়িতে থাকা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা টেলিমেডিসিন সেবার আওতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তবে যে হারে রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে তাতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত মানুষ সরকারি চিকিৎসাসেবার বাইরে থেকেই যাচ্ছে। এ হার প্রতিদিনই বাড়ছে।

এদিকে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর শ্বাসকষ্ট কিংবা অন্য কোনো সমস্যা আকস্মিক বেড়ে যাওয়ার পর তাকে দ্রম্নত হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে কী করতে হবে, কোথায় কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে- এসব ব্যাপারে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। ফলে এ পরিস্থিতিতে রোগীর স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনায় আক্রান্তের তথ্য গোপন করে মুমূর্ষু রোগীকে নন-কোভিড হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করছেন। এতে হিতে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যেকোনো সময়, এমনকি গভীর রাতেও সমস্যা জানানোর নির্দিষ্ট স্থান থাকতে হবে, দ্রম্নত যেন অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে, রোগীকে কোন হাসপাতালে তাৎক্ষণিক নিয়ে গেলে নিশ্চিত সেবা পাওয়া যাবে, তা জানারও ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে দিশেহারা মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এছাড়া নিরাপত্তার কথা ভেবে মৃদু উপসর্গ থাকা রোগীও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করবে। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুরুর দিকে শুধু আইইডিসিআরের চিকিৎসকরা বাড়িতে থাকা করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। মানুষ ফোন করে সেবার বিষয়ে জেনে নিতেন। আবার নিয়মিত বিরতিতে আইইডিসিআরের চিকিৎসকরাও রোগীকে ফোন করতেন। তবে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সে তৎপরতা আগের মতো ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। টেলিমেডিসিন সেবায় 'স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ নম্বর' যুক্ত হলেও সেখানেও জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে কোনো রোগী ফোন করলে কল সেন্টারে থাকা চিকিৎসকরা তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকের অভিযোগ, স্বাস্থ্য বাতায়নে কল করে কতটা সহায়তা পাওয়া যায় তা ভুক্তভোগীরাই ভালো জানেন। রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা রুবি আহমেদ জানান, তার ছোট ভাইয়ের করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তিনি মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তার উপসর্গ মৃদু থাকায় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। আকস্মিক শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে জরুরি যোগাযোগ করার জন্য তাকে একজন চিকিৎসকের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। ঈদের আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ মে রাতে তার আকস্মিক শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা ওই ফোন নম্বরে কল করে তা বন্ধ পান। এ সময় তারা দিশেহারা হয়ে স্বাস্থ্য বাতায়নে কল করেন। দীর্ঘ সময় পর লাইন পাওয়ার পর সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক দায়সারা কিছু পরামর্শ দিলেও রোগীকে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা কিংবা কোন হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা মিলবে এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করতে পারেননি।

ধানমন্ডির বাসিন্দা ইকবাল হোসেনও একই ধরনের অভিযোগ করে জানান, ব্যাংকে চাকুরিরত তার বড় সন্তান করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তবে আকস্মিক তার অবস্থার অবনতি হলে সরকারিভাবে কারো সহায়তা পাননি। পরে সরকারের উচ্চপদস্থ তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র সুপারিশে তিনি ছেলেকে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করাতে পেরেছিলেন। তাৎক্ষণিক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা না গেলে তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ত বলে চিকিৎসকরা স্বীকার করেন।

শুধু রুবি আহমেদ কিংবা ইকবাল হোসেনই নন, তাদের মতো আরও বিপুলসংখ্যক ভুক্তভোগীর কাছ থেকেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101232 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1