শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কারফিউ ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রে তুমুল বিক্ষোভ, লুটপাট

যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ জুন ২০২০, ০০:০০
সামাজিক সাম্যের দাবিতে নিউইয়র্কে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন হাজারো মানুষ -ইন্টারনেট

অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন নয়, পুলিশের গাড়ির সাইরেনে আমেরিকার বড় বড় নগরীর রাত কাটছে এখন। ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ আর লুটপাটের বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে আমেরিকার নাগরিক আন্দোলনের নতুন মাত্রা পাচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের উচ্চারণে এখন শুধু পুলিশের হাতে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের বিচার নয়, জনতার দাবিও বিরাট হয়ে উঠেছে। স্থানে স্থানে সামাজিক সাম্যের দাবিতে রাস্তায় অবস্থান করছেন বিক্ষোভকারীরা। কারফিউ ভেঙে চলছে ক্ষুব্ধ মানুষের উত্তাল আন্দোলন।

ষষ্ঠ দিনের মতো ২ জুন নিউইয়র্কে হাজারো মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল ছিল। বৃষ্টিভেজা রাতেও নগরীর ব্রম্নকলিন থেকে ম্যানহাটন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের স্স্নোগানমুখর পদচারণ চলছে। আগের রাত থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। তবে লুটপাটের বিচ্ছিন্ন ঘটনা চলছে। আন্দোলনকারী ও পুলিশের সতর্ক অবস্থানের কারণে আগের রাতের লুটপাটের পুনরাবৃত্তি ঘটছে না।

এদিকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃতু্যর ঘটনাও একেবারে থামেনি। নিউইয়র্কে ২ জুন ৫৮ জনের মৃতু্যর সংবাদ জানানো হলেও জনতার আন্দোলনের কাছে এ সংবাদ এখন চাপা পড়ছে। অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিলেও স্বাস্থ্যসেবীরা মনে করছেন, ভাইরাসের সংক্রমণ এতে বেড়ে যেতে পারে। আগামী দুই-তিন সপ্তাহে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তার দিকেই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে সবাই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে নির্বিকার ভূমিকায় আছেন। সেনা মোতায়েন করে কঠোরভাবে দমনের অবস্থানে তিনি এখনো অনড়। মানুষের ক্ষোভ নিরসনের জন্য এখনো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো বক্তব্য নেই। যদিও সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছেন, এখন বক্তৃতা দেওয়ার সময় নয়, শোনার সময়।

নিউইয়র্কে ১ জুন রাতে কারফিউ ভেঙে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ৭ জুন পর্যন্ত রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা অবধি কারফিউ জারি থাকবে। তবে জরুরি বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। উবার, লিফটসহ সব ট্যাক্সি সার্ভিস ৩ জুন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বন্ধ থকবে। তবে ইয়েলো ও গ্রিন ক্যাব রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগের কর্মীদের পরিবহণ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রীদের জরুরি কাজের প্রমাণ দেখাতে হবে পুলিশকে।

১ জুন কারফিউ জারির প্রথম রাতে নিউইয়র্কে রেকর্ডসংখ্যক ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্য নগরীতে রাত ৮টা থেকে কারফিউ জারি হলেও নিউইয়র্কে রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা হয়। এ নিয়ে সমালোচনায় পড়েছেন মেয়র বিল ডি বস্নাজিও। রাজ্য গভর্নর অ্যান্ডু কুমো প্রকাশ্যে বলেছেন, মেয়র পরিস্থিতির নাজুকতা ও ব্যাপ্তি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর সমালোচনা করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বলেছেন, 'লুটপাটকারী, ডাকাত, চরমপন্থী বাম এবং অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির কাছে হেরে গেছে নিউইয়র্ক। গভর্নর সেনাবাহিনী মোতায়েনে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিউইয়র্ককে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে।' আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে বামপন্থীদের নেপথ্যে থাকার দাবির পক্ষে ট্রাম্প কোনো প্রমাণ হাজির করেননি।

কুমো বলেছেন, সহিংসতা ও লুটপাটের ঘটনায় তিনিও ক্ষুব্ধ এবং শহরের মেয়র ও পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। মেয়র বিল ডি বস্নাজিও সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি বলে তিনি মনে করেন।

নিউইয়র্ক নগরীতে ব্যাপক লুটপাট হওয়ায় তোপের মুখে পড়েছেন মেয়র ডি বস্নাজিও। গভর্নর সরাসরি মেয়র বস্নাজিও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মন্তব্য করে বলেছেন, মেয়রকে বরখাস্ত করার অধিকার তার রয়েছে। যদিও এমন কোনো চিন্তা এখনো তিনি করছেন না। নিউইয়র্ক নগরীতে ৩৮ হাজার পুলিশ সদস্য। এরপরও এনওয়াইপিডি পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গভর্নর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সেনা মোতায়েনের নির্দেশনার সমালোচনা করে বলেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার এ উদ্যোগে তিনি নেই। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লতিশা জেমস।

নিউইয়র্কের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় দুই নেতার মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। দুই ডেমোক্র্যাট নেতা কুমো ও বস্নাজিওর মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা বিদ্যমান আগে থেকেই। মেয়র বস্নাজিও বলেছেন, গভর্নর ভুল করছেন, তার বক্তব্য ভুল। ব্যক্তিগত মতাদর্শিক মতপার্থক্য থাকলেও গভর্নরের সঙ্গে কাজ করতে তার কোনো অসুবিধা নেই। গভর্নরের বক্তব্য নিউইয়র্ক এনওয়াইপিডি সদস্যদের জন্য অসম্মানের এবং এর জন্য গভর্নরের তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

বিক্ষোভ দমনে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ জুন কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নরদের সমালোচনা করেছেন। বিক্ষোভ চলাকালে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প এই সমালোচনা করেন। এরপর থেকে পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভে আরও উত্তেজনা বেড়েছে।

ওইদিন বেলা ১১টা থেকেই নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল করে লোকজনকে বিক্ষোভে যোগ দিতে দেখা যায়। রাত ৮টায় কারফিউ দেওয়া হলেও হাজারো মানুষ তা অমান্য করে মিছিল করছেন। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হচ্ছে। ব্রম্নকলিন ও ম্যানহাটনে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। রাত ১২টার মধ্যেই নিউইয়র্কে দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।

সেনা মোতায়েনে ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে অ্যান্ডু্র কুমো বলেন, নিউইয়র্কের জমায়েত মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ না থাকা বাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে।

ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ লেঙ্গিয়েল বলেছেন, ১ জুন রাতে বিভিন্ন শহরে সহিংসতা কমেছে। যদিও বিক্ষোভ আগের মতোই আছে। রাতে কোনো সেনাসদস্য আহত হননি। সেনা কর্মকর্তা জানান, ২৯টি অঙ্গরাজ্যে ১৮ হাজার সেনাসদস্য স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছেন এবং এই সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিস্নউ বুশ এবং সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে শ্বাসরোধে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে আমেরিকায় দমন-পীড়নের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বেশ কয়েক দিন পর প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যাপারে বুশ বলেছেন, এখন বক্তৃতা দেওয়ার সময় নয়, এখন সময় কথা শোনার। যারা আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণকে টার্গেট করে হত্যা করেছে, বুশ তাদের নিন্দা জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে যারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছেন, তাঁদের সমর্থনও দিয়েছেন।

আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃতু্য হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে চাওভিন ফেঁসে যান। সেখানে দেখা যায়, গলায় হাঁটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিঃশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার চাওভিনকে বলছেন, 'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।' ভিডিওটি ভাইরাল হলে চাওভিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। মিনেসোটা থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আমেরিকায়। কৃষ্ণাঙ্গদের পাশাপাশি অনেক শ্বেতাঙ্গও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন চাওভিন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিচারের অপেক্ষায় এখন কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101235 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1