বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাভাইরাস

বাড়ছে মৃত্যু, কমছে সচেতনতা

জাহিদ হাসান
  ০২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

লকডাউন খোলার পর সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। গত মঙ্গলবার (৩০ জুন) রেকর্ড ৬৪ জনের মৃত্যু দেখল দেশবাসী। এরপরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। দিন যতই যাচ্ছে মানুষের মধ্যে সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের উদাসীনতা ততই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে সচেতন না হলে কোনোভাবেই এ মহামারি থেকে দ্রম্নত মুক্তি মিলবে না। সম্প্রতি এ উদাসীনতাকে উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, যতদিন ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার না হবে ততদিন সবাইকে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে চলাফেরা করতে হবে। সুরক্ষা সরঞ্জাম যেমন- সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস, গাউন, মাস্ক, হ্যান্ডগস্নাভস, ফেসশিল্ড, বিশেষ চশমা, বিশেষ জুতা (পিপিই) ব্যবহারের মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো কঠোরভাবে মানতে সরকারের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগও লকডাউনসহ উলিস্নখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এসব পদ্ধতি অনুসরণ করে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফলতা পাওয়া দেশগুলো করোনার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা সঠিকভাবে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারসহ হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলার নির্দেশনা দিলেও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে না। এতে করে দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামেতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রমণের প্রকোপ কমানো যাচ্ছে না। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে রাজধানীসহ ঢাকার বাইরে একাধিক এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে অধিকাংশ মানুষই সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার বা সচেতন হয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করছেন না। বিশেষ করে হাট-বাজার, কলকারখানা রিকশা-ভ্যান, লেগুনা-সিএনজি চালক, বাস-ট্রাকের মতো গণপরিবহণ শ্রমিক ও ছিন্নমূল মানুষ করোনার ভয়াভয়তার চেয়ে জীবন-জীবিকাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন পেশার মানুষ যুক্তি দেখিয়েছেন। এদেরই একজন মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকার রিকশাচালক রতন মিয়া (৫০)। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'করোনাকালের আগে বাসের হেলপারি করতাম। ৪ মাস আগে হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হওয়ায় ৫ সদস্যের সংসার চালাতে এখন ভাড়ার রিকশা চালাই। রোদে ঘেমে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবিকা অর্জন করতে গিয়ে মাস্ক বা পিপিই পরার ধৈর্য থাকে না।' শুধু রতন মিয়াই নন, তার মতো খেটে খাওয়া আরও অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে একই উত্তর পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা শনাক্তের শুরুর দিকে সংক্রমণের সংখ্যা কম থাকলেও আতঙ্কের কারণে সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংকটে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট দূর করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও বিদেশি সহযোগিতা পর্যন্ত নিতে হয়; কিন্তু এখন সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়লেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেকটাই কমে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির এক সদস্য যায়যায়দিনকে বলেন, গত চার মাস ধরে ভাইরাসটির সংক্রমণ মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সরকার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি ১০০ জনের কম রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন জেলাগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা ও পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলেছিল। এজন্য গণপরিবহণ ব্যবহারে শিথিলতা, কনট্রাক্ট ট্রেসিং বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ৩০ মে সরকারি ছুটি শেষ করে লকডাউন উঠিয়ে সবকিছু খুলে দেওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে পরবর্তী ২০ দিনে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এমনকি এই ২০ দিনে দেশে প্রায় ৭০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিধিনিষেধ শিথিলের পর সংক্রমণ আরও বাড়ছে, বিশ্বের এমন ১০টি দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশের অবস্থান চলে আসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষক যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির ফলে উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ায় অনেকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশসহ অনেকে দেশে বিশ্বমন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিলের একটি জাতীয় জরিপেও দেখা গেছে, দেশের ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আগে এই হার ছিল ২০ শতাংশ। যেটি এখন মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ দরিদ্র। দরিদ্রতার ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানার তোয়াক্কা না করে জীবিকা অর্জনের পেছনে ছুটছে। আর অসচেতনতায় একে অন্যের মাধ্যমে সংক্রমিত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, জনসচেতনতা যথেষ্ট না হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ নিয়ম মেনে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন না। স্বাস্থ্যবিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যাপক সমন্বয়হীনতা থাকায় রাষ্ট্র মানাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ করোনা মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কায় (কলোম্ব ছাড়া) ও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টেনে কারফিউ জারিসহ জনজীবন স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছে। নেপালে আগামী আগস্ট পর্যন্ত ও পশ্চিমবঙ্গে ৩০ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেরও উচিত, ডবিস্নউএইচওর পরামর্শ অনুযায়ী মোটিভেশনের মাধ্যমে সামাজিক জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ, আনসার সদস্যদের মাধ্যমে কঠোরতা আরোপ করা। সংক্রমণ হার অনুযায়ী কর্মকৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষ মানতে বাধ্য হবে। এভাবে চার থেকে ৬ মাসের মধ্যে সংক্রমণ কমে আসবে। তবে সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আকতার যায়যায়দিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত চলমান ভাইরাসটির কোনো প্রতিষেধক তৈরি না হওয়ায় সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সচেতনতা একমাত্র ওষুধ। এজন্য সরকারও চেষ্টা করছে। পত্র-পত্রিকাসহ গণমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছে। প্রতিদিনের অনলাইন বুলেটিনে ব্যক্তিগত সচেতনতার কথা বলা, জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন, দেশের সব হাসপাতালের চিকিৎসক ও জেলা সিভিল সার্জনদের তাগাদা দেওয়া, সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য কাজ করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে