শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাভাইরাস

সুস্থ হওয়ার পরও রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি!

জাহিদ হাসান
  ০৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন ৬৬ হাজার ৪৪২ জন, যা মোট আক্রান্ত সংখ্যার হার হিসেবে ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। যা বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির পজিটিভ দিক। বৈশ্বিক আক্রান্তে শীর্ষ ২০-এ বাংলাদেশ থাকলেও মৃতু্যহার এসব দেশ থেকে কম হওয়ায় অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে দেশবাসীকে। কিন্তু সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হতে পারেন কি না, তাদের অন্যান্য রোগব্যাধি পরিস্থিতি কী এসব জানতে পারছে না।

সুস্থ হওয়া একাধিক রোগী এবং চিকিৎসকরা জানান, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর ফুসফুসের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ফুসফুসের নরম অংশগুলো নষ্ট হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ফলে ফুসফুসে বাতাসের থলিগুলো (বেলুনের মতো) ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং ক্লান্তিবোধ দেখা দেয়। ভবিষ্যতে ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই করোনা থেকে মুক্তি মিললেও শিশু, গর্ভবতী ও বয়স্ক, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হার্টের রোগীদের চিকিৎসকের ফলোআপে থাকার প্রয়োজন হয়। এছাড়া দীর্ঘস্থায়ী রোগব্যাধিতে ভোগা ব্যক্তিরা করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর অন্যান্য রোগে কীভাবে সুস্থ থাকবেন, অতীতের রোগগুলোর চিকিৎসা কীভাবে নেবেন তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন।

করোনায় চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পর কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে কি না, সেগুলোর উপসর্গ, সমস্যা এবং প্রতিরোধের উপায় কী, এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন ধারণা নেই। ফলে সুস্থতা-পরবর্তী দ্বিতীয়বার সংক্রমণসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসকদের সঠিক তথ্য জানানো উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনের তথ্যমতে, ২ জুলাই পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ৮ লাখ ২ হাজার ৬৫৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭ জনের দেহে ভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৪৪২ জন সুস্থ হয়েছেন। তবে নমুনা সংগ্রহের কিট সংকটে বিভিন্ন সময় দেশের ল্যাবগুলোতে এক কিটে দুজনের নমুনা পরীক্ষার করতে দেখা গেছে। এছাড়া অনেক ল্যাবে একই ব্যক্তির ফলাফল দুই রকম আসায় মান নিয়ে বিতর্ক উঠছে। আবার করোনা থেকে সুস্থতা-পরবর্তী অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুুঁকির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধলে স্ট্রোক হতে পারে, হৃদযন্ত্রে হলে হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুসে হলে পালমোনারি অ্যাম্বোলিজম হতে পারে। এমনকি পায়ের শিরায়ও রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। পায়ের পেছনের বড় শিরায় রক্ত জমাট বাঁধলে তা সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হয়ে মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সুস্থতার সংজ্ঞা পরিবর্তন আনার পর আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে সুস্থহার হার বাড়ছে। তবে এভাবে যাদের সুস্থ বলা হচ্ছে তাদের সবাই পুরোপুরি সংক্রমণমুক্ত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ ৬ মাস আগে যখন ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন এর চিকিৎসকরা অনেকটা অন্ধকারে ছিলেন। শুরুতে চিকিৎসকরা জানতেন না যে, করোনা আক্রান্ত রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া রোগীকে উপুড় করে শুইয়ে রাখলে ফুসফুসের ওপর চাপ কমে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অনেক রোগীর ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয় না। একইভাবে প্রথমদিকে চিকিৎসকদের ধারণা ছিল করোনাভাইরাস শুধু শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসে আক্রমণ করে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এটি ফুসফুস, কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কেও আক্রমণ করতে পারে। তাই করোনা পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হওয়ার পর পুনরায় কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, হলে সেটির লক্ষণগুলো কী, চিকিৎসকদের উচিত, সে ব্যাপারে রোগী ও স্বজনদের স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া।

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে করোনা রোগীর সুস্থতার মানদন্ড নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়, ভাইরাস শনাক্তের পর চিকিৎসা শেষে রোগী সুস্থ অনুভব করলে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর দুটি পরীক্ষায় সংক্রমণ পাওয়া না গেলে তিনি (নেগেটিভ) করোনামুক্ত। এরপর গত ৩ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সুস্থতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে। তাতে বলা হয়, ওষুধ ছাড়া টানা ৩ দিন জ্বর না থাকলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট সমস্যার উলেস্নখযোগ্য উন্নতি হলে রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে। তবে রোগীকে বাড়িতে বা সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং সম্ভব হলে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।

সর্বশেষ ২৮ জুন তৃতীয়বারের মতো এ সংজ্ঞা পরিবর্তন করে সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে পরপর তিন দিন রোগী করোনা উপসর্গবিহীন থাকলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবেন। পরপর ১০ দিন উপসর্গবিহীন থাকলে রোগীর করোনাভাইরাসমুক্ত ধরে নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ রোগীর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট, কাশি এবং ক্লান্তিবোধ অনুভব হয়। তখন বাতাস থেকে পরিমাণ মতো অক্সিজেন নিয়ে রক্ত দিতে পারে না। রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্রম্নত অকেজো হয়ে পড়ে। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সুস্থতা-পরবর্তী সামান্য কাজে হাঁপিয়ে ওঠা বা শ্বাসকষ্ট সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) এক চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, মার্চে চীনের এক জরিপ ফলে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ৭০ রোগীর মধ্যে ৬৬ জনই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও মারাত্মক শ্বাসকষ্ট, কাশি এবং ক্লান্তিবোধের নানা সমস্যা রয়ে গেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানচেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্স ও ইতালিতে টক্সিক শক ও কাওয়াসাকি রোগের লক্ষণের মতো কিছু উপসর্গে ভুগছে শিশুরা। বাংলাদেশের এভার কেয়ার (সাবেক এ্যাপোলো) হাসপাতালে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে দুই শিশু ভর্তি হয়েছে। ফলে সরকারের উচিত, কো-মরবিডিটি অর্থাৎ আগে থেকে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভোগা রোগীদের করোনা আক্রান্ত থেকে সুস্থতা লাভের পর আবার করোনাজনিত নানা রোগব্যাধি এড়ানোর উপায় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<104777 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1