শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহামারি ঠেলে দিচ্ছে অন্য পেশায়

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০
ঢাকা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করেও পেটের দায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন এই যুবক। ছবিটি মঙ্গলবার তোলা -বিডিনিউজ

করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষায় প্রয়োজন ছাড়া যেখানে ঘরের বাইরে বেরোতে মানা, সেখানে এই মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকটে পেট চালাতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে বহু মানুষকে।

ঢাকার রামপুরার একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন চক-ডাস্টার ফেলে মোটরসাইকেলের হাতলে রেখেছেন হাত। সেখান থেকে যে আয় হচ্ছে তা দিয়েই চালাচ্ছেন তিনি সংসার।

মধ্যবয়সি এই ব্যক্তি জানান, তারা কয়েকজন মিলে বাচ্চাদের এই বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ১৭ মার্চ থেকে তাদের কিন্ডারগার্টেনটিও বন্ধ রয়েছে।

'স্কুল খুলবে খুলবে বলে তিন মাস অপেক্ষা করেছি। স্কুল খোলার অনুমতি আসে না। দিন দিন খারাপ হচ্ছে পরিস্থিতি। স্কুল কবে খোলা যাবে জানি না। কোনো দিন যদি খুলতেও পারি তখন শিক্ষার্থী পাব কি না কে জানে!'

এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গত ১০ দিন ধরে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন জানিয়ে নিজের আর স্কুলের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই ব্যক্তি।

কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও হোটেলের উত্তরপাশে কথা হয় এই বাইক চালকের সঙ্গে। যাত্রীর জন্য নিজের বাইকে বসেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে একটু অপ্রস্তুত লাগছিল তাকে। নাম, পরিচয়, ছবি কোনোটাই প্রকাশ করা হবে না, এমনটি জানানোর পর কথা বলেন তিনি।

এই ব্যক্তি জানান, কয়েক বছর আগে চালু করা ওই কিন্ডারগার্টেন থেকে যা আয় হতো ভবন ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ মেটানোর পর তা দিয়ে তাদের ভালোই চলছিল।

স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। 'এখন বাসা ভাড়া দিতেই কূলকিনারা পাচ্ছি না। প্রতিদিনের খাবারের জন্য টাকা লাগে।'

বাচ্চাদের স্কুল চালিয়ে কিছু টাকা জমালেও ভবিষ্যৎ বিপদের কথা ভেবে সব টাকা খরচ না করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে নেমেছেন তিনি।

প্রাণঘাতী এ ভাইরাস থেকে রক্ষায় দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

মোটরসাইকেলে যাত্রী উঠালে শরীর ঘেঁষেই তাকে বসাতে হয়। কোনো যাত্রী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কি না, খালি চোখে তা বোঝার উপায়ও নেই।

এমন পরিস্থিতিতে অপরিচিত যাত্রী মোটরসাইকেলে তুলতে অস্বস্তি লাগে না?

আনুমানিক ৪০ বছর বয়সি এই ব্যক্তি বলেন, 'অনেক ভয় লাগে, কিন্তু কী করব বলেন? ঘরে থাকলেও মরব, বাইরে বের হলেও মরব, মরার আগে যে মরতে চাই না বলেই বের হয়েছি। পকেটের সব টাকা খরচ করে ফেলব সে উপায়ও নেই। অসুখ বা বিপদে তো টাকা লাগে, তখন পাব কোথায়? এখন খুবই খারাপ সময়, কখন কী হয় বলা তো যায় না।'

এখন কেমন ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কোনো কোনো দিন ৫০০ টাকার মতো পাওয়া যায়। আমি খুব বেশি ভাড়া পাই না। টেকনিকটা ভালো জানি না যে। যারা নিয়মিত চালায় তারা কীভাবে যেন যাত্রী ম্যানেজ করে ফেলে।'

তার মতোই এই মহামারিতে পেশা বদল হয়েছে মিরপুরের একটি মিষ্টির দোকানের বিক্রেতা এক যুবকের।

ঢাকা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজে ছিলেন তিনি। নিজের খরচ চালাতে মিরপুরের একটি নামি মিষ্টির দোকানে বিক্রেতার কাজ করতেন।

মিষ্টির দোকানে ব্যবসা ভালো না থাকায় এখন সেই দোকান মালিকই বিপাকে পড়েছেন। চাকরি না গেলেও পরিস্থিতি বুঝে আর সেখানে যাচ্ছেন না ওই তরুণ।

মুখে বড় একটি রুমাল বেঁধে কারওয়ান বাজারের ইটিভি ভবনের পাশে বাইক নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর লকডাউন শুরু হলে গ্রামের বাড়ি নওগাঁ গিয়েছিলেন। গত রোজার ঈদের আগে নওগাঁ থেকে নিজের মোটরসাইকেল ঢাকায় এনেছেন।

'এখন এভাবে বাইকে যাত্রী তোলায় রিস্ক তো আছেই। দিনে অন্তত ৫-৭ জনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসতে হয়। রিস্ক থাকলেও আমার সামনে এখন অন্য উপায় নেই।'

সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫০০-৬০০ টাকার মতো পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে এই বাইক রাইডার বলেন, কোনো কোনো দিন একটু বেশি পাওয়া যায়।

মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি মোবাইল ফোনের শোরুমে সেলসম্যানের চাকরির জন্য ভাইভা দিয়েছি, তারা বলেছেন ফোনে জানাবেন। অন্য কোনো চাকরি না হওয়া পর্যন্ত বাইক চালাব।'

দেড় বছর ধরে ঢাকায় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান মেহেদী হাসান। গুলশান লিঙ্করোডের বাড্ডা সংযোগের পাশে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বাইকের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছিলেন তাদের অনেককেই জিজ্ঞাসা করছিলেন বাইক লাগবে কি না।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাইকে যাত্রী তুলতে ভয় করে না- এমন জিজ্ঞাসায় মেহেদী বলেন, 'একসময় ভয় লাগত, এখন বেশি ভয় পাই না। ভয় পেয়ে লাভ কী?'

যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, সে ভাইরাসকে কেন ভয় পান না সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আনুমানিক ২৫ বছর বয়সি মেহেদী।

'এখন যাত্রীরা বাইকে ওঠার আগে নিজেরাই স্প্রে মারে। কেউ কেউ স্প্রে করে তো সিট ভাসিয়ে দেয়। আমিও মাঝেমধ্যে স্প্রে সাথে রাখি, দুদিন ধরে আমার স্প্রে শেষ হয়ে গেছে।'

উবার, পাঠাওয়ের মতো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার মাধ্যমে মোটরসাইকেল চালিয়ে আগে প্রতিদিন দেড় হাজার টাকার মতো আয় হলেও মহামারির মধ্যে এখন তা ৫০০-৬০০ টাকায় নেমে এসেছে বলে জানান মেহেদী। অ্যাপগুলো বন্ধ থাকায় এখন ভাড়া মিটিয়ে বাইকে যাত্রী তুলছেন তিনি।

মেহেদী বলেন, 'এখন এমনিতেই বাইকের যাত্রী কম। তার মধ্যে বৃষ্টি হলে সব শেষ, যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন দিনের খরচটাও তোলা যায় না।'

হাতিরঝিলের রামপুরা ব্রিজের পাশে প্রতিদিনই বাইক নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় বেশকিছু বাইকারকে। অ্যাপ বন্ধ থাকায় তারাও এখন দরদাম করে ভাড়া ঠিক করে যাত্রী তুলছেন।

আগে উত্তর বাড্ডায় একটি জুতার দোকানে কাজ করতেন ফরিদুর রহমান। দোকান মালিক ঠিকমতো বেতন না দেওয়ায় বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে বাইক কিনেছেন তিনি।

'আগে ভালো আয় হতো, আমার চাকরির থেকে অনেক বেশি টাকা কামাতাম। করোনা আসার পর আয় অনেক কমে গেছে, মানুষ বাইকে উঠতে ভয় পায়, আমরা যাত্রী পাচ্ছি না।'

রামপুরা ব্রিজের কাছে হাতিরঝিলে বাইক ভাড়ার চেষ্টা করছিলেন ফল বিক্রেতা সাদেকুল। এ পরিস্থিতিতেও কেন ভাড়ার বাইকে উঠবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'বাইকেই সব চেয়ে কম সময়ে এখান থেকে ফার্মগেট (তার গন্তব্য) যাওয়া যায়, ভাড়াও কম পড়ে।'

করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে পাবলিক বাসে ওঠার চেয়ে মোটরসাইকেলে চড়া নিরাপদ বলে মনে করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105932 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1