শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাভাইরাস

হাসপাতাল-বিমানবন্দরে চালু হচ্ছে 'অ্যালাইজা টেস্ট'

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৮ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

প্রচলিত আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা টেস্ট যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ হওয়ায় নমুনা দেওয়ার পর থেকে এর ফল পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়েও অনেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় সঠিকভাবে টেস্ট করানোর পরও নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশের বিমান যাত্রীরা অনেকে বিদেশের মাটিতে নেমে বিপাকে পড়ছেন। সেখানকার বিমানবন্দরে তাৎক্ষণিক টেস্টে কারও কারও শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের সে দেশে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ ধরনের একাধিক ঘটনায় বাংলাদেশের নমুনা পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহির্বিশ্বে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তিও ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। সঙ্কটময় এ পরিস্থিতিতে যাত্রীদের কাছে আরটি-পিসিআর পদ্ধতির নমুনা পরীক্ষার সনদ থাকলেও শাহজালাল ও শাহ আমানতসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সবারই ঊখওঝঅ অ্যালাইজা (এনজাইম-লিংকড ইমিউনোসোর্বেন্ট সিলিজিক অ্যাস) টেস্ট করা হবে। এতে ভ্রমণের সময় ওই যাত্রীর শরীরে যে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নেই তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। দিনক্ষণ নির্ধারণ না হলেও এ কার্যক্রম শিগগিরই চালু হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, অ্যালাইজা টেস্ট চালু হলে বিদেশের মাটিতে দেশের যাত্রীদের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা যেমন কমবে; তেমনি জাল সনদ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণের কারণে বহির্বিশ্বে যে অনাস্থা ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে তা-ও দ্রম্নত হ্রাস পাবে। একইভাবে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তা বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে ধরা পড়বে। ফলে করোনায় আক্রান্ত প্রবাসী কিংবা বিদেশিদের দেশে প্রবেশের সুযোগ বন্ধ হবে।

এদিকে শুধু করোনার নমুনা পরীক্ষার সংকটের কারণে দেশের সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটাতে জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে মহানগরী পর্যায়ের সব হাসপাতালেও অ্যালাইজা টেস্ট চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কিডনি ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি সাধারণ রোগীরাও সহজে চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে। যদিও এ ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গুরুতর রোগী এলে, তার কোভিড টেস্ট রিপোর্ট না থাকায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। এতে অনেক ক্ষেত্রে মৃতু্যর ঘটনাও ঘটছে। অথচ মাত্র ১৫ মিনিটে অ্যালাইজার্ যাপিড টেস্ট করা গেলে, পজিটিভ-নেগেটিভ যাই হোক না কেন, রোগীকে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া যাবে। ফলে দেশে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির পর সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা-ও পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হবে।

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী এবং এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, শুরুতেই দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে অ্যালাইজা টেস্ট কার্যক্রম চালু করা হলে প্রবাসী ও বিদেশিদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। এছাড়া সম্প্রতি দেশ থেকে করোনামুক্তির জাল সনদ নিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালেয়শিয়ায় যাওয়ার পর সেখানে তাদের আটকে দেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে, তা-ও ঘটত না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন সম্পর্কিত নীতিমালার খসড়া তৈরি করে তাদের কাছে পাঠিয়েছে। যা যাচাই-বাছাই করের্ যাপিড টেস্টের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সে অনুযায়ী অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন কিট কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন দেবে। যদিও এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এ কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।

তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আরটি-পিসিআরের পাশাপাশি অ্যান্টিজেন টেস্টের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা দেশের সর্বস্তরে কার্যকর করতে বেশ অনেকটা সময় লাগবে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের সব হাসপাতাল ও তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অ্যালাইজা পদ্ধতিতে অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেখানে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেলে ক্রমান্বয়ে অন্য স্তরেও তা চালু করা হবে।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ব্যাপারে যত দ্রম্নত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, দেশের জন্য সেটি ততই মঙ্গল বয়ে আনবে। তাদের ভাষ্য, অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে একটি কমিউনিটিতে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে কতজনের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং যে কারণে তাদের পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটা- সেটা নির্ণয় করা যাবে। দেশের অফিস-আদালত, কলকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সমুচীন হয়েছে কিনা তার প্রমাণও মিলবে। কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসকসহ অন্যান্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কী অবস্থা সেটা বোঝার জন্য এবং ভ্যাকসিন টেস্ট করার জন্যও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা এসবের জন্যইর্ যাপিড টেস্টের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় যেসব অসুবিধা রয়েছে, অ্যান্টিজেনে তা নেই। এই পরীক্ষা যেমন সহজে করা যায়, তেমনই মেশিনের দরকার হয় না। আলাদা ল্যাবরেটরি বা যে কোথাও করা যায়, এর জন্য বায়োসেফটির দরকার নেই। এমনকি এ টেস্টের নমুনা সংগ্রহের জন্যও তেমন দক্ষ লোকবলের প্রয়োজন হয় না। ফলে দেশের উপজেলা পর্যায়েও সহজেই এ পরীক্ষা করা সম্ভব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, কোনো একটা অ্যান্টিজেন প্রাকৃতিকভাবে বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে যদি মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়, তখন দেহে যে ইমিউনুকমপিটেন্ট সেলগুলো আছে, তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় অ্যান্টিবডি। তাই আমরা যদি সেরোসার্ভিল্যান্স করতে চাই, কমিউনিটির স্ন্যাপশট নিতে চাই, তাহলে আমাদের অ্যান্টিবডি টেস্ট করাতে হবে। এই টেস্টের মাধ্যমে আমরা ভিন্ন সময়ে বা ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে শতকরা কত ভাগ লোক আক্রান্ত তা জানতে পারব। অ্যালাইজা টেস্টের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে সেখানে প্রটেকটিভ লেভেলটা আসলে তা আমরা জানতে পারব। তবে আরডিটি বা ক্রোমোটোগ্রাফি টেস্টের মাধ্যমে মানবদেহে কতটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তা জানা যায় না। তাই সেক্ষেত্রে অ্যালাইজা টেস্টের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি টেস্ট করালে আক্রান্ত হওয়ার অষ্টম দিনের মধ্যে অ্যান্টিবডি কোন মাত্রায় আছে তা জানা যাবে। এই টেস্ট করাতে পারলে ভ্যাক্সিনের অযথা প্রয়োগও কমবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি দুটো পরীক্ষাই আরডিটি র্(যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট) এবং অ্যালাইজা পদ্ধতিতে করা যায়। তবে অ্যালাইজা পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে তাতে করে নিদিষ্ট প্রটেকটিভ লেভেল বা 'অ্যান্টিবডি টাইটার' বোঝা যায়। আর আরডিটি দিয়ে কেবল পজিটিভ-নেগেটিভ বলা যাবে, সুনির্দিষ্টভাবে কতটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সেটা বলা যাবে না।

অ্যালাইজা টেস্ট কী?

এটি একটি এনজাইম-লিঙ্কযুক্ত ইমিউনোসোর্বেন্ট অ্যাস, যা ইলিসা বা ইআইএ নামেও পরিচিত। এ পরীক্ষা রক্তে অ্যান্টিবডিগুলো শনাক্ত করে এবং পরিমাপ করে। নির্দিষ্ট সংক্রামক অবস্থার সঙ্গে অ্যান্টিবডি রয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করতে গত দুই দশক ধরে এই পরীক্ষাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যান্টিবডিগুলো এমন প্রোটিন যা শরীর অ্যান্টিজেন নামক ক্ষতিকারক পদার্থের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উৎপাদন করে।

অ্যালাইজা টেস্ট শুধু করোনা শনাক্তের জন্যই নয়, এইচআইভি, যা এইডস সৃষ্টি করে, লাইম ডিজিজ, মারাত্মক রক্তাল্পতা, ভেরেসেলা-জস্টার ভাইরাস এবং জিকা ভাইরাস শনাক্তের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছে।

পরীক্ষাটি কীভাবে করা হয়?

অ্যালাইজা পরীক্ষাটি খুবই সহজ। এটি রক্তের একটি পরীক্ষা। নমুনা সংগ্রহকারী ব্যক্তি শরীর থেকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের জন্য পরীক্ষাগারে পাঠায়। ল্যাবটিতে একজন টেকনিশিয়ান একটি পেট্রি থালায় নমুনা যুক্ত করে। পরে নমুনা থেকে পরীক্ষা করতে হবে এমন অ্যান্টিজেনগুলো একটি পৃষ্ঠের সাথে সংযুক্ত করা হয়। কোনও মিলিত যাতে এটি অ্যান্টিবডি পৃষ্ঠের উপরে প্রয়োগ করা অ্যান্টিজেনকে আবদ্ধ করতে পারে। এই অ্যান্টিবডিটি একটি এনজাইমের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং তারপরে যে কোনও আনবাউন্ড অ্যান্টিবডিগুলো সরানো হয়। চূড়ান্ত পদক্ষেপে, এনজাইমের সাবস্ট্রেটযুক্ত একটি পদার্থ যুক্ত করা হয়। যদি সেখানে বাঁধাই হয় তবে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া শনাক্তকরণযোগ্য সংকেত তৈরি করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রং পরিবর্তন হয়।

ঊখওঝঅ সম্পাদন করতে একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের নির্দিষ্টতাসহ কমপক্ষে একটি অ্যান্টিবডি জড়িত। অজানা পরিমাণ অ্যান্টিজেনসহ নমুনা একটি শক্ত সমর্থন (সাধারণত একটি পলিস্টেরিন মাইক্রোটিটার পেস্নট) হয় বিশেষভাবে (পৃষ্ঠতলে শোষণের মাধ্যমে) বা বিশেষত (একই অ্যান্টিজেনের সাথে নির্দিষ্ট অন্য কোনও অ্যান্টিবডি দ্বারা ক্যাপচারের মাধ্যমে)। 'স্যান্ডউইচটিতে' অ্যান্টিজেন স্থির হওয়ার পরে, শনাক্তকরণ অ্যান্টিবডি যুক্ত করা হয়, অ্যান্টিজেনের সাথে একটি জটিল গঠন করে। শনাক্তকরণ অ্যান্টিবডি একটি এনজাইমের সাথে পড়াধষবহঃষু সংযুক্ত হতে পারে বা নিজেই একটি গৌণ অ্যান্টিবডি দ্বারা শনাক্ত করা যেতে পারে যা জৈব জংশনের মাধ্যমে একটি এনজাইমের সাথে যুক্ত। প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে, পেস্নটটি সাধারণত কোনও হালকা ডিটারজেন্ট দ্রবণ দিয়ে ধোয়া হয়, যাতে নির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ নয় এমন কোনও প্রোটিন বা অ্যান্টিবডিগুলো অপসারণ করা যায়। চূড়ান্ত ধোয়ার পদক্ষেপের পরে, দৃশ্যমান সংকেত তৈরি করতে একটি এনজাইম্যাটিক স্তর যোগ করে পেস্নটটি বিকশিত হয়, যা নমুনায় অ্যান্টিজেনের পরিমাণ নির্দেশ করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108093 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1