বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আস্থার সংকটে বেকায়দায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো

আহমেদ তোফায়েল
  ০৮ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

আস্থার সংকটে চরম বেকায়দায় পড়েছে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। একদিকে যেমন কমে গেছে ঋণ আদায়, অন্যদিকে বেড়েছে অর্থ উত্তোলনের চাপ। গ্রাহকরা প্রায় সব প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমানতকারীরা ২০১৯ সালে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা বেশি তুলে নিয়েছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ৪৫ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা তুলেছেন গ্রাহকরা। আগের বছরের একই সময়ে গ্রাহকের টাকা তোলার পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ করে পিপলস লিজিং অবসায়নের পর এ সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। যদিও পরিস্থিতি মোকাবিলায় একসঙ্গে অর্থ উত্তোলন না করতে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আস্থার সংকটের কারণে কেউ অর্থ রাখতে চাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই-একটি প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো আথিক প্রতিষ্ঠান খাতে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এরই ধারাবাহিকতায় কিছু ব্যাংক তাদের তহবিল উত্তোলন করে নিয়েছেন। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংকট দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহুমুখী সংকটে পড়ে গেছে। প্রথমত, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছিল। বুঝে, না বুঝে আমানতের বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। কিন্তু যারা ঋণ নিয়েছিলেন তারা আর ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না।

আবার কেউ কেউ সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চ সুদে আমানত নিয়েছেন। আর ওই আমানতের অর্থ নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। কিন্তু ওই অর্থ আর ফেরত দিচ্ছেন না। এতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত আর তারা ফেরত দিতে পারছেন না।

এতে দেখা দিয়েছে আস্থার সংকট। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম অর্থের জোগান দেয় দেশের ব্যাংকগুলো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ফেরত দিতে পারছে না। এতে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে তাদের আমানতের অর্থ সংরক্ষণ করতে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলন করতে চাচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন আর ব্যাংকের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। এতে নতুন করে কোনো ব্যাংক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমানত দিচ্ছে না। এভাবেই নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।

এদিকে তহবিল সংকটের কারণে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণকার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দার কারণে পুঁজিবাজার থেকে মুনাফানির্ভর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বেকায়দায় পড়ে গেছে। এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ও এনআরবি গেস্নাবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভরসার স্থান আরও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সবমিলিয়েই অনেক প্রতিষ্ঠানের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধেই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যনুযায়ী, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের ৯৬ দশমিক ৪৫ শতাংশই স্থায়ী আমানত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বা ২ হাজার ৩৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ২২ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৪ হাজার ৬০ কোটি ২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ আমানত ৪২৮ কোটি ৯ লাখ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮১ কোটি ৪৩ লাখ টাকায়। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭০৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অর্থ ফেরত দিতে না পারার কারণে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আমানতকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

এদিকে, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না এমন অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) পুনর্গঠন চেয়েছে এ খাতের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন বা বিএলএফসিএ। সম্প্রতি এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। চলতি বছরের মধ্যে অন্তত একটি রুগ্‌ণ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে বিএলএফসিএ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে পাঠানো প্রস্তাবের ওপর শিগগিরই একটি বৈঠক হতে পারে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বিএলএফসিএর পক্ষ থেকে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং ছাড়াও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উলেস্নখ করা হয়নি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের সব আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে বাজারে এই বার্তা দেওয়া হোক যে, আমানতকারীর টাকা মেরে পার পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি মমিনুল ইসলাম বলেন, খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানের একটি খসড়া সংস্কার প্রস্তাব গভর্নর বরাবর দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগিরই তাদের নিয়ে বৈঠক করবে বলে আশা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে বলে জানান তিনি।

সংশ্নিষ্টরা জানান, এমনিতেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি কম থাকায় আমানত পেতে বেগ পেতে হয়। অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চরম খারাপ অবস্থা সামনে আসায় পুরো খাতের প্রতি সাম্প্রতিক সময়ে আস্থাহীনতা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের ধাক্কা আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকে চরম সংকটে ফেলেছে। এখন অনেক আমানতকারী মেয়াদ পূর্তির আগেই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। নতুন আমানত আসছে খুব সামান্য। আবার এই সময়ে ঋণের আদায় আগের মতো হচ্ছে না।

দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অবসায়নের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। গত বছরের ১৪ জুলাই পিপলসের অবসায়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদন গ্রহণ করেন আদালত। অনিয়মে জড়িত পরিচালকদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় ও প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এক বছরেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমানতকারীরা কবে টাকা ফেরত পাবেন তাও নিশ্চিত করে জানে না কেউ।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত ঋণখেলাপির তালিকায় ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। ঘুরেফিরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম আসছে বিভিন্ন অনিয়মে। তালিকায় রয়েছে পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্র্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বিআইএফসির মালিকানায় ২০১৪ সালে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। এনআরবি গেস্নাবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে যান বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108098 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1