মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
করোনার প্রভাব

তলানিতে নেমেছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ

আহমেদ তোফায়েল
  ০৯ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিস্থিতি কেমন তা অনুমান করা যায় শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির চিত্র দিয়ে। এ খাতে বিনিয়োগ যে তলানিতে নেমেছে তার প্রমাণ শিল্পের এ দুটি উপাদান আমদানির পরিসংখ্যানে। রপ্তানি হ্রাসের সঙ্গে বিদায়ী অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনার কালো থাবার কারণে শিল্পে নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। আর নতুন বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে ধস নেমেছে। পণ্য রপ্তানি না বাড়লে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করবে না, বিনিয়োগ না করার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস পাচ্ছে এটাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণপত্রের নিষ্পত্তির হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৪০২ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছিল ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মূলধনী যন্ত্রপাতি ঋণপত্র খোলাকে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। এক বছরে ঋণপত্র খোলা যে হারে কমেছে তাতে বিনিয়োগের নেতিবাচক খবর দিচ্ছে। একই সময়ে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি সূচিত হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে যে হারে রপ্তানি আয় কমেছে, আগামীতেও অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। রপ্তানি না বাড়লে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবে কোথায়। এছাড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে তা থেকেও উদ্যোক্তারা অর্থ পাচ্ছে না। এসব কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে নতুন করে রপ্তানি হচ্ছে না। রপ্তানি কমে গেছে এ কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা হচ্ছে না। করোনার কারণে বিশ্ববাজারে মন্দা, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়া ও প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পেরে না ওঠার অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। এ কারণে নতুন করে বিনিয়োগ করার চিন্তা-ভাবনা করছে না শিল্পের উদ্যোক্তারা।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে না গিয়ে তাদের বিদ্যমান সক্ষমতা ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, 'মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নেতিবাচক প্রবণতা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে কতটা সময় লাগবে তা অনুমান করা কঠিন।'

বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগ থেকেই নতুন বিনিয়োগে ধীরগতি ছিল। এর সাথে গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে মূলত বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যায়। নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা বিদ্যমান বিনিয়োগ চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। গত এপ্রিল থেকে বেশিরভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ থাকে। এতে চলমান বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়। এর বাইরে ব্যাংকগুলোতেও টাকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। গত কয়েক মাসে ব্যাংকে টাকা জমার চেয়ে উত্তোলন হয় বেশি হারে। এতে ব্যাংকের অর্থ ব্যবস্থাপনা কঠিন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। এছাড়া সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থও পাচ্ছে না ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই থেকে বিনিয়োগ কমা শুরু হয়েছে। বিনিয়োগের এ নিম্নগতি আজও চলছে। প্রথমবারের মতো গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ওই মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফেব্রম্নয়ারিতে আরও কমে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশে আসে। এরপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও তলানিতে নেমে গেছে, যা এপ্রিলে এসেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে।

একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানিয়েছেন, সরকার এক লাখ কোটি টাকার ওপরে প্রণোদনা দিয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা নেই। আবার এ মুহূর্তে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ করলে সে অর্থ ফিরে পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। অপরদিকে, প্রণোদনার যে অংশটুকু পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে প্রদান করা হবে, ব্যাংক গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে ফেরত না পেলেও ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই অর্থ কেটে নেবে। সব মিলেই ব্যাংকগুলো এখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের সুবিধা নিতে চাচ্ছে না।

এদিকে করোনার কারণে সরকারের কোনো নীতি-সহায়তাই কাজে আসছে না। ব্যাংকগুলো যাতে বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগসীমা বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল সংকট মেটাতে নগদ জমার হার অর্থাৎ সিআরআর হার কমানো হয়েছে। স্বল্প সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যাতে ধার নিতে পারে সে জন্য রেপোর হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল সংকট মেটাতে রেপোর মাধ্যমে যাতে বেশি হারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারে সে জন্য রেপোর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ধার নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরপরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বরং দিন দিন তা তলানিতে নেমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত সুযোগ দেওয়ার পরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রথমত করোনার কারণে চলমান পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। না ব্যবসায়ী, না কোনো ব্যাংক, দুই পক্ষের কেউই এগিয়ে আসছে না। তবে কিছু কিছু ব্যবসায়িক গ্রম্নপ ঋণ নেওয়ার জন্য ব্যাংকে ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু তাদের অতীত রেকর্ড ভালো না। অপরদিকে সুদহার বেঁধে দেওয়া। বাজার অর্থনীতিতে সুদহার চাপিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হয় না। ব্যাংকাররা বলেন, ১৭-১৮ শতাংশ সুদহার যখন ছিল তখনও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর অন্যতম কারণ হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা, পরিবেশ পরিস্থিতি, যারা তহবিল জোগান দেবেন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে। নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এর ওপর গত দেড়-দুই বছর ধরে সুবিধাবাদী একশ্রেণির ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবসায়ী গ্রম্নপ অসাধু উদ্দেশ্যে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যাংকিং খাতকে নিয়ম-নীতির মধ্যে চালানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। তারাই সুদহার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে ভুল পথ দেখাতে সহযোগিতা করে আসছে। এর ফলে ব্যাংকাররা বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। বেশিরভাগ ব্যাংক ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাচ্ছে না। নানাভাবে তারা উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করলে তাদের লোকসান দিতে হবে। এ কারণেই অনেকেই বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।

তাহলে ব্যাংকের বিনিয়োগ কোথায় যাচ্ছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে একজন এমডি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের পরিবর্তে বেশি মুনাফার আশায় সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডেই বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। কারণ সরকারকে ঋণ দিলে এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি মুনাফা পাওয়া যায়। আর সরকারের ঋণ দেয়াটাও ব্যাংকগুলোর নিরাপদ বিনিয়োগ বলা চলে। কারণ এখানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ কারণেই ব্যাংকগুলো এখন ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। অপরদিকে একশ্রেণির ব্যবসায়ী গ্রম্নপ যারা ব্যাংক মালিক হয়েছেন তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে অন্যদের আর ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। এসব কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের এমন নিম্নগতি অবস্থা।

প্রসঙ্গত, করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তি খাতে সরকার ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি অংকের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। খাতভিত্তিক বড়, ছোট, মাঝারি সবার জন্যই ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজ দেওয়া হয় এবং এসব প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট দূর করতে বেশকিছু সুবিধাও প্রদান করা হয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সে উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ অর্থ 'ভাগাভাগি' হচ্ছে এমনভাবে যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের গুরুত্বই থাকছে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108199 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1