বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৪৫ বছরেও অধরা বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনি

ফয়সাল খান
  ১৫ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ আগস্ট ২০২০, ১০:৩৩

বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অধরা ৫ খুনি। জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলায় মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত হলেও দেশে না থাকায় তাদের দন্ড কার্যকর করতে পারেনি সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারগুলোর অনীহা, কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা ও বিভিন্ন দেশের আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এসব খুনিকে দেশে আনা সম্ভব হয়নি। তবে এসব খুনিকে দেশে ফিরিয়ে শাস্তি কার্যকর করতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দলীয় নেতাকর্মীরাও তৎপর রয়েছেন। কিন্তু পরপর তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরও বঙ্গবন্ধুর সব খুনির রায় কার্যকর করতে না পারায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনি এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী পলাতক রয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করে কানাডায় তার সম্ভাব্য অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে তার জন্য রেড নোটিশ জারি করা হয়। এ রেড নোটিশের মেয়াদ ৫ বছর। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখা কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরীর সম্ভাব্য অবস্থান আমেরিকায়। তার বিরুদ্ধে ২০১৮ ও ২০০৯ সালে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। রেড নোটিশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, তা আরও ৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করছে। তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব না হলেও সে পাকিস্তান বা লিবিয়ায় অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। খুনি লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের অবস্থান শনাক্ত না হলেও তারও সম্ভাব্য অবস্থান লিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে বলে জানা গেছে। ২০০৯ ও ২০১৯ সালে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে সম্ভাব্য অবস্থান ভারত বা পাকিস্তান বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ নিয়ে ভারতের পুলিশের ইন্টারপোল শাখায় যোগাযোগ করা হয়েছে। এখনো ইতিবাচক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে ২০০৯ ও ২০১৮ সালে রেড নোটিশ জারি করা হয়। এ রেড নোটিশের মেয়াদও আগামী ৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এদিকে, আত্মগোপনে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে সারাবিশ্বে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। রেড নোটিশ পেয়ে বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকা খুনি-অপরাধীদের সে দেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এ প্রক্রিয়া জোরালোভাবে শুরু করেছে সরকার। জানা গেছে, পালিয়ে থাকা ৫ আত্মস্বীকৃত ও মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত খুনির মধ্যে দুজনকে ফেরানোর ব্যাপারে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ এম রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় থাকা এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। কানাডায় মৃতু্যদন্ড প্রথা বিলোপ হওয়ায় এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে ফেরানোটা আটকে আছে আইনি প্রক্রিয়ায়। নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে পাঠানোর আগে ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা প্রি-রিস্ক রিমুভাল অ্যাসেসমেন্টের (পিআরআরএ) বিষয়ে রায় পেতে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কানাডার সরকার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করেছে। ২০১৯ সালের মার্চে মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। এছাড়া রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্কাডেন এল এলপি নামে একটি আইনি পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ করেছে সরকার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম যায়যায়দিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাকি খুনিদের দেশে ফেরানোর জন্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। তাদের কিভাবে ফেরানো যায়, এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দলীয় নেতাকর্মীরাও তৎপর রয়েছে। নেতাকর্মীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গঠন ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনাকারী ও নেপথ্য নায়কদের মুখোশ উন্মোচন করতে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র এ নেতা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। মূল পরিকল্পনাকারীদের মুখোশ উন্মোচন না করলে পুরোপুরি দায়মুক্তি হবে না বলে জানান তিনি। প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। বঙ্গবন্ধুর তদানীন্তন এপিএস মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। সিআইডির এএসপি আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট (নং-৭) দাখিল করেন। চার্জশিটে ২০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ১১ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন জজ কোর্ট থেকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ে ১৫ আসামিকে মৃতু্যদন্ড ও ৫ আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃতু্যদন্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃতু্যদন্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃতু্যদন্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃতু্যদন্ডাদেশ বহাল থাকে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান আজিজ পাশা। সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ এপ্রিল রেড নোটিশধারী আসামি লে. আবদুল মাজেদকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে