মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইমেজ রক্ষায় সতর্ক পুলিশ

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা রাশেদ সিনহার মৃতু্য এবং দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ও হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ তার পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে নানা মানবিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নিজেদের ইমেজে নতুন মাত্রা যুক্ত করলেও সম্প্রতি এ বাহিনীর মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার অপকর্ম-দুর্নীতিতে তা খানিকটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা রাশেদ সিনহার মৃতু্য এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ও হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের অন্তত আধা ডজন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বিব্রত পরিস্থিতিতে ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার গোপন কিংবা প্রকাশ্য খবর সংগ্রহকারী ইউনিট ইন্টারনাল ওভারসাইটের (পিআইও) ভূমিকা নিয়ে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব পালনের নামে মাঠপর্যায়ে নানা অপকর্মে সম্পৃক্ত অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরতে ঊর্ধ্বতনদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর এ সংক্রান্ত বার্তা এরই মধ্যে রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলা এসপিদের কাছে পাঠিয়েছে। এতে পুলিশ কনস্টেবল থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর, বিশেষ করে ওসিদের নৈমিত্তিক কর্মকান্ড তীক্ষ্ন নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উচ্চাভিলাষী দুর্নীতিবাজ, বেপরোয়া ও নানা অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রম্নত চিহ্নিত করে তাদের সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরকে অবহিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিটি সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখার জোরালো নির্দেশনা রয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইট (পিআইও) ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষায় ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠানো বিশেষ সতর্ক বার্তায় মাঠপর্যায়ের তদারকিতে কোনো ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ পেলে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা হিসেবে ধরা হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রস্তুতি রয়েছে বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। সুপারভাইজিং কর্মকর্তাদের সঠিক নজরদারির অভাবে ওসিসহ মাঠপর্যায়ের মুষ্টিমেয় পুলিশ সদস্য নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে শীর্ষ প্রশাসন মনে করছে।

তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা এ জন্য পুলিশের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা, চেইন অব কমান্ডে দুর্বলতা এবং পিআইওর অদক্ষতাকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, মাঠপর্যায়ের বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তা রাজনৈতিকভাবে এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে, তারা অতীতে ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের কে কোন পদে কতদিন অধিষ্ঠিত ছিলেন তা নিয়ে প্রকাশ্যে বড়াই করছেন। আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কের বিষয়টি নানাভাবে জানান দিয়ে নানা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন। এ ধরনের কর্মকর্তারা বেশিরভাগই ঊর্ধ্বতনদের কমান্ড নির্বিঘ্নে অবজ্ঞা করছেন।

অপরাধ পর্যবেক্ষকরা জানান, অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের বাইরেও পুলিশ সদস্যদের অসদাচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রতিকারের জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এজন্য সারা বিশ্বে দুটো পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। পদ্ধতির ধরন অনুসারে এগুলোকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা (ওহঃবৎহধষ ঙাবৎংরমযঃ) এবং বহির্বিভাগীয় ব্যবস্থা (ঊীঃবৎহধষ ঙাবৎংরমযঃ) নামে অভিহিত করা হয়।

ইন্টারনাল ওভারসাইট বা অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় পুলিশের মধ্য থেকেই একটি পৃথক ইউনিট পুলিশ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার গোপন কিংবা প্রকাশ্য খবর সংগ্রহ করে। যা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কিংবা অভ্যন্তরীণ ইউনিটের নিজস্ব তথ্যমত বা সংস্থার বাইরে থেকে পাওয়া পাবলিক পিটিশন অনুসারে হতে পারে। ইন্টারনাল ওভারসাইট তাদের পাওয়া তথ্যগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। অনেক সময় তারা নিজেরাও অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কিংবা ফৌজদারি মামলা রুজু করে। ইন্টারনাল ওভারসাইটের কর্মকর্তারা অনেক সময় ফাঁদ পেতেও অভিযুক্ত অফিসারদের অপরাধের আলামতসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেন। অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনাল ওভারসাইট শুধু গোপন তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশ প্রধানকে অবহিত করে। পুলিশ প্রধান পরবর্তীতে এসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকাশ্য অনুসন্ধান চালানোর জন্য অন্য শাখার কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

অথচ পুলিশের ইন্টারনাল ওভারসাইট বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় যে ব্যর্থ হয়েছে, তা কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের একের পর এক চাঞ্চল্যকর অপকর্মের তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, ইন্টারনাল ওভারসাইট নিময়মাফিক তাদের কার্যক্রম চালালে ওসি প্রদীপ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকতের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা এভাবে দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারতো না। ওসি প্রদীপের ইয়াবা পাচার, চাঁদাবাজি ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়সহ নানা অপকর্মের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরও পিআইওর টনক না নড়ার বিষয়টি রহস্যজনক বলেও মনে করেন অপরাধ পর্যবেক্ষকরা।

তবে পিআইওর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেকনাফের ঘটনায় তাদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে দাবি করেন। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশের মধ্যে অনেক স্তর আছে। আইজিপির দেওয়া নির্দেশ স্তরে স্তরে পার হয়ে কনস্টেবল পর্যন্ত যাবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা বলবে, সেই অনুযায়ী সবাই কাজ করবেন। থানার ওসিসহ পুলিশের সব সদস্য আইনের বিধি-বিধান অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে চলবেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এগুলো মেনে চলেন না। থানার ওসিরা কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ভাবেন এবং নির্বিঘ্নে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের এর প্রতিবাদ করার কথা থাকলেও তারাও অনেক সময় এসব অপকর্মের সহযোগী হয়ে ওঠেন। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীরাও কখনো কখনো নিশ্চুপ হয়ে যান। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসপিরা ওসির অপকর্মের ভাগিদার হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পিআইওর পক্ষ থেকে অভিযোগ তুলেও কোনো ফল পাওয়া যায় না। ফলে পুলিশের হাতে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী মানুষের আর্তনাদ অধিকাংশ সময় নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে যায় না। এসব পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে শুধুমাত্র পুলিশের মাঠপর্যায়ের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে দাবি করেন পিআইওর ওই কর্মকর্তা। তিনি মনে করেন, থানার ওসিদের সঙ্গে উপরের মহলের প্রভাবশালীদের যোগাযোগ থাকে, সেগুলো খুঁজে বের করা জরুরি।

এদিকে, পুলিশের একাধিক সাবেক আইজি এ প্রসঙ্গে বলেন, থানার ওসিসহ মাঠপর্যায়ের সদস্যদের অতি ক্ষুদ্র অংশ অপকর্মে সম্পৃক্ত হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকারান্তরে গোটা বাহিনীর ওপরই পড়ে। তাই তাদের চিহ্নিত করে দ্রম্নত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাঞ্চল্যকর অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসার পর গত কয়েকদিনে যেভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ছে তা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তারা।

পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, কক্সবাজারে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে নেতিবাচক তথ্য মিলেছে। তাদের অন্যায় প্রমাণিত হলে প্রত্যেকের চাকরি যাওয়া উচিত; শাস্তি হওয়া উচিত। পুলিশ যাতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সুপারভিশনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেটি সঠিকভাবে করা না হলে তাদের অপকর্মের সম্পৃক্ততা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক।

পুলিশের আরেক সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, 'জনগণের সঙ্গে যদি পুলিশের দূরত্ব কমানো না যায় তাহলে পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার অন্ত থাকবে না।' অপরাধে জড়িত পুলিশদের বের করে দেওয়া গেলে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহারকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছরা তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সাত পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পর স্বল্প সময়ে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বিরুদ্ধে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েছে। এমনকি এ নিয়ে আদালতে মামলা রুজুরও একাধিক ঘটনা ঘটেছে।

ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে গত ১২ আগস্ট রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গোলাম মোস্তফা নামের এক ব্যবসায়ী একটি মামলা করেন। একই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার দুই সাব-ইন্সপেক্টরসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলাতেও আসামিদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন আগে অর্থাৎ ১০ আগস্ট রাজধানীর কোতোয়ালি থানার অফিসার্স ইনচার্জ মিজানুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে স্থানীয় এক কাপড় ব্যবসায়ী মামলা করেন। এ মামলাতেও আসামিদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। কক্সবাজার সদর থানার ওসি শাহজাহান কবিরের বিরুদ্ধে থানা হেফাজতে এক মাদক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ১১ আগস্ট তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ১০ আগস্ট নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার ওসি মিজানুর রহমান এবং এক সাব-ইন্সপেক্টরসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক নেতাকে পুলিশ হেফাজতে নৃশংস নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তাদেরকে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সরিয়ে দিয়ে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108960 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1