বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ এলোমেলো ভোটের ছক!

নতুন পরিকল্পনা সাজানো বিএনপির পক্ষে কঠিন হবে মনোনয়ন বাতিলের রেকডের্ সুষ্ঠু নিবার্চন নিয়ে উদ্বেগ দুবর্ল প্রাথীর্র পক্ষে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না নেতাকমীর্রা মন্তব্য করার সময় আসেনি, মনে করেন পযের্বক্ষকরা
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:২৬

যাচাই-বাছাই শেষে নানা অসংগতি দেখিয়ে গত রোববার নিবার্চন কমিশন দেশের বিভিন্ন আসনে বিএনপির বিপুল সংখ্যক শক্তিশালী প্রাথীর্র মনোয়নপত্র বাতিল ঘোষণার পর অনেকটা পাল্টে গেছে আসন্ন একাদশ সংসদ নিবার্চনে তাদের ভোটের ছক। বিশেষ করে যেসব আসনে বিএনপি কিংবা তাদের জোটের যোগ্য বিকল্প প্রাথীর্ নেই, সেখানকার ভোটের হাওয়া এরইমধ্যে এলোমেলো বইতে শুরু করেছে। বিএনপিসমথির্ত ভোটারদের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন হতাশা। নানা ঝুঁকি নিয়েও মাত্র ক’দিন আগেও বিএনপির যেসব নেতা ভোটের মাঠে কমীের্দর চাঙ্গা করতে সবোর্চ্চ তৎপর ছিলেন, তারাও অনেকে এখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এদিকে সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রাথীের্দর মনোনয়ন বাতিলের রেকডর্ নিয়েও বিভিন্ন মহলে এরইমধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশয় সৃষ্টি হয়েছে ইসির স্বকীয়তা ও নিরপেক্ষ নিবার্চন নিয়ে। নিবার্চন সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ কিংবা আদালতে দÐিত হওয়াসহ নানা তথ্যের অসংগতির কারণে বিএনপির ১৪১ জন এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রাথীের্দর গণহারে মনোনয়ন বাতিল করা হলেও ক্ষমতাসীন দলের মনোনীতরা এর ব্যতিক্রম। সারা দেশের তাদের মাত্র তিনজনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। যদিও দল মনোনীত প্রাথীের্দর মধ্যে বেশ ক’জন চিহ্নিত ঋণখেলাপিও রয়েছেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নিবার্চন ঘিরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল তাতেও ভাটার টান ধরেছে। নিবার্চন পযের্বক্ষকরা মনে করেন, নানা প্রতিক‚লতা ঠেলে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিতে বিএনপি এতদিনে যতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছিল মনোনয়ন বাতিলের ধাক্কায় তাদের সে ছক অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই আসন্ন ভোটযুদ্ধে ঘুরে দঁাড়াতে হলে ফের নতুন করে তাদের নিবার্চনী পরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে, যা স্বল্প সময়ে গুটিয়ে আনা সত্যিকার অথের্ই কঠিন। এদিকে যেসব আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রাথীর্ নেই সেখানকার স্থানীয় নেতা ও বিএনপিসমথির্ত ভোটারদের হতাশার চিত্র অনেকটাই স্পষ্ট। রাজধানীর সবুজবাগ-মুগদা-খিলগঁাও নিয়ে গঠিত ঢাকা-৯ আসনের বিএনপিসমথর্ক একাধিক ভোটার জানান, মিজার্ আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের মনোনয়ন বাতিল হওয়ার পর তারা অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রাথীর্ সাবের হোসেন চৌধুরীর বিপক্ষে বিএনপির বিকল্প প্রাথীর্ হাবিবুর রশীদ হাবিবকে জিতিয়ে আনা আদৌও সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে খোদ সেখানকার গুরুত্বপূণর্ নেতারাও ঘোর সংশয়ে রয়েছেন। এদিকে ঢাকা-১ আসনে বিএনপির দুই প্রাথীর্ ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু আশফাক ও নবাবগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান ফাহিমা হোসাইন জুবলির মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় সেখানকার ভোটের হাওয়া পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দলীয় প্রাথীর্হীন এ আসনে স্থানীয় নেতাকমীর্রা কার পক্ষে কাজ করবেন, দলসমথির্ত ভোটারদের কাকে ভোট দেয়ার পরামশর্ দেবেন তা নিয়ে চলছে এলোমেলো পরিকল্পনা। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ নিবার্চনে বতর্মান এমপি স্বতন্ত্র প্রাথীর্ সালমা ইসলামের পক্ষে কাজ করার মত দিলেও অনেকেই তার বিরোধিতাও করেছেন। এছাড়া বিএনপি সমথর্ক ভোটারদেরও অনেকের এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। ফলে সবমিলিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতারা কঠিন চাপের মুখে রয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে দলীয় নেতাকমীের্দর নিয়ে ভোটের মাঠে ঝঁাপিয়ে পড়া সত্যিকার অথের্ই কঠিন বলে খোদ বিএনপির স্থানীয় নেতারা মন্তব্য করেছেন। এছাড়া শরীয়তপুর-১, মানিকগঞ্জ-২, বগুড়া-৭, জামালপুর-৪ ও রংপুর-৫ এই পঁাচ আসনে বিএনপির সব প্রাথীর্র মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় সেখানকার নেতাকমীর্ ও সমথর্করা চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আপিলে তারা প্রাথির্তা ফিরে না পেলে শূন্য হয়ে যাওয়া আসনগুলোতে বিএনপির অনানুষ্ঠানিক সমথর্ন কাকে দেয়া হবে তা নিয়ে বিএনপির কেন্দ্র ও স্থানীয় পযাের্য় নানামুখী আলোচনা চলছে। এসব বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর নিবার্চনী নতুন ছক কষে নেতাকমীের্দর তোড়জোড়ে ভোটের মাঠে নামানোর মিশন কতটা সফল হবে তা নিয়ে খোদ নেতারাই এখনো সন্দিহান। মাঠ পযাের্য়র নেতারা জানান, একাধিক মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বিএনপির নেতাকমীর্রা দলীয় প্রাথীর্র জন্য ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামার ছক কষলেও স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দলীয় কোনো প্রাথীর্র পক্ষে অনেকেই স্বক্রিয়ভাবে কাজ করতে রাজি হবেন না। এমনকি বিএনপিসমথির্ত ভোটাররাও অনেকেই এ ব্যাপারে ততটা উৎসাহ না দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় নিবার্চনী নতুন ছক তৈরি করে তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে বিএনপি দলীয় ও ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রাথীের্দর মনোনয়ন বাতিলের হিড়িক নিয়ে সাধারণ ভোটাররা নানামুখী প্রশ্ন তুললেও এ নিয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে মনে করছেন নিবার্চন পযের্বক্ষকরা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং নিবার্চন বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে এখন মন্তব্য করা ঠিক হবে না যে বিরোধীজোট এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কমিশনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চ‚ড়ান্ত মন্তব্যের জন্য ৮ ডিসেম্বর পযর্ন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অনেকেরই খুবই সামান্য কারণে মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। যেগুলোতে বাতিল হওয়ার কথা ছিল না। যেমন স্বাক্ষরে ত্রæটি বা লেখার অস্পষ্টতাসহ কিছু বিষয়। এগুলো আপিলে সহজেই উতরে যাবে। আবার ঋণখেলাপিদের বিষয়ে দল বা ব্যক্তিভেদে আইনের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ হয়েছে কি না সেটাও চ‚ড়ান্তভাবে বলা যাবে ৮ ডিসেম্বরের পর। তার ধারণা, যাদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে এদের একটি বড় অংশই আপিলে উতরে যাবেন। সেটা যদি না যায় তখন বড় দাগে অভিযোগ তোলা যাবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক লুৎফুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, ‘কি হয়েছে বা কি হচ্ছে সেটা বলতে গেলে প্রত্যেকটি মনোনয়ন বাতিলের কারণগুলো নিদির্ষ্ট করে দেখতে হবে। তা হলেই বলা যাবে কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে বিরোধী জোট এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের প্রাথির্তা বাতিল করা হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা করে দেখে না। তারা এ বিষয়ে একটি সামগ্রিক মনোভাব পোষণ করছে। আমিও এ বিষয়ে যতটুকু জেনেছি, সাধারণ মানুষ একচেটিয়াভাবে বিরোধী এবং বিদ্রোহীদের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় এখানে নিবার্চন কমিশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না এমন একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। শুধু মনোনয়নই নয় পুলিশের আচরণ, মামলা, হামলা, গ্রেপ্তারও আগের মতোই অব্যাহত থাকায় সুষ্ঠু নিবার্চন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। নিবার্চন হয়তো হবে। তবে একচেটিয়াভাবে বিরোধী এবং বিদ্রোহীদের মনোনয়ন বাতিল, মামলা, হামলা, গ্রেপ্তার চলতে থাকলে নিবার্চন আসলে কতটা সুষ্ঠু হবে এবং জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব বের হয়ে আসবে কি না তা নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যাবে।’ এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এভাবে ব্যাপক সংখ্যায় মনোনয়ন বাতিল কাম্য নয়। আপিলে এদের একটি অংশ উতরে যাবে বলে আশা করা যায়। তবে তাও যদি না যায় তবে এটা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তা অনাকাক্সিক্ষত নয়।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে