শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
তদন্ত প্রতিবেদন

স্কুল কর্ত্তৃপক্ষের নির্দয়-নির্মম আচরণেই অরিত্রীর আত্মহত্যা

যাযাদি রিপোটর্
  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:৩৭
বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ Ñযাযাদি

অরিত্রী ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুল কতৃর্পক্ষের নিমর্ম ও নিদর্য় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপযর্স্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাজধানীর নামি প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহননের পর গঠিত কমিটি স্কুলটির নানা অনিয়মের সত্যতাও পেয়েছে। স্কুলটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অধিকতর তদন্তেও যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রীকে পরীক্ষার হলে মোবাইলে নকল করার অভিযোগ পেয়ে তার অভিভাবককে ডেকে অপমান ও হেয় করা হয়। মেয়ের সামনে বাবা-মাকে অপমান করার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এই স্কুলছাত্রী। সহপাঠীর অকাল মৃত্যুতে ফুঁসে উঠেছে বেইলি রোডের এই প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রীরা। তিন দিন আগে অরিত্রীর আত্মহননের পরপরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিদেের্শ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি রাত-দিন কাজ করে প্রতিবেদন দেয় বুধবার। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অরিত্রীর অকাল মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা মমার্হত, ব্যথিত। খুবই অমানবিক। ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন ছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছিল, সেখান থেকে সূচনা। তারপরে পরবতীের্ত যে ঘটনা ঘটেছে এর ফলে সে আত্মহত্যা করে।’ বিষয়টি স্পশর্কাতর হওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদন দ্রæত দেওয়া হয়েছে বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, ‘নরমালি ডিলে হয়, কিন্তু এটা এমন একটা বিষয় যা দেরি করার মতো নয়। যার ফলে সদস্য-কমর্কতার্রা সবাই মিলে সহযোগিতা করে চেষ্টা করেছি যাতে দ্রæতই করতে পারি। ওই রাত তারা সম্পূণর্ খেটেছেন, পুরো দিন কাজ করেছেন এবং গত রাত আড়াইটায় এসে পৌঁছেছেন।’ নাহিদ বলেন, ‘প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি, প্রতিবেদন পযাের্লাচনা করেছি। প্রতিবেদনে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে।’ কী উঠে এসেছে তদন্তে? তদন্ত প্রতিবেদন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এখানে বলা হয়েছে, এই তিনজন, অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসলেন, তারা খুবই অসুস্থ, তাদের ভয়-ভীতি দেখান, অরিত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে অধ্যক্ষ, শিফট ইনচাজর্ নিমর্ম, নিদর্য় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপযর্স্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। ‘অরিত্রীর বাবা-মায়ের প্রতি অপমান ও অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সিফট ইনচাজর্ এবং শ্রেণিশিক্ষিকা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে অরিত্রীর আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে অভিযোগে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া পারে। তদন্ত প্রতিবেদন পযাের্লাচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে বরখাস্ত করার জন্য গভনির্ংবডিকে নিদের্শ দিচ্ছি। একই সঙ্গে এই তিনজন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না। থানাও যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে। আমি আশা করছি তারাও ব্যবস্থা নেবেন। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’ হুঁশিয়ারি বাতার্ সবার জন্য অরিত্রীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ ধরনের ঘটনা যদি নাও হয়ে থাকে তাহলেও নানা কারণে নানাভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ‘আমরা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ম্যানেজিং কমিটি কিংবা সরকারি হলে তার পরিচালক, মাধ্যমিক, প্রাইমারি স্কুল, ইউনিভাসিির্ট, মাদরাসা, টেকিনিক্যাল প্রতিষ্ঠান আছে; সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, আমাদের পূবর্ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নিযার্তন করা যাবে না। এটা অপরাধ। এই হিসেবে যারা শাস্তি পেয়েছেন তারা তো পেয়েছেন, আর যারা করবেন তারা আরো বেশি করে শাস্তি পাবেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, সব শিক্ষক এ রকম নয়। ভালো শিক্ষক রয়েছেন। দরদি শিক্ষক রয়েছেন, শিক্ষাথীের্ক ভালোবাসেনÑএমন শিক্ষক আরো বেশি এগিয়ে আসবেন, অন্য শিক্ষককে প্রভাবিত করবেন। ‘ম্যানেজিং কমিটিতে যারা আছেন, তারা শুধু খবরদারি করার জন্য নয়, সাবির্কভাবে শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষাথীের্দর-শিক্ষকের গুণগতমান উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নে আরো বেশি করে নজর দেবেন। আমরা আরো বেশি নজরদারি করব।’ অন্তহীন অভিযোগ ভিকারুননিসায়! এই নামি প্রতিষ্ঠানে ভতির্র জন্য অভিভাবকেরা গলদঘমর্ হয়ে পড়েন। কিন্তু তার আড়ালে রয়েছে অন্ধকার সব কমর্কাÐ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে যেসব অনিয়ম ও অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো উঠে এসেছে। অভিভাবকেরা নানা ধরনের অভিযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পরে আমি অসংখ্য টেলিফোন পাচ্ছি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন। ‘অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বলেননি। বলে যে আমরা সাহস পাইনি, বললে তারা আমার মেয়েকে নানা রকমের সমস্যায় ফেলতে পারে সেই কারণে। একজন অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, আমি অপদস্থ হয়েছিলাম। বলে যে, সাহস করিনি, আমার নাতনির জীবন শেষ হয়ে যায় এ কারণে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আরো অনেকগুলো অনিয়ম, অসঙ্গতির বিষয় গাডির্য়ান, শিক্ষাথীের্দর কাছ থেকে পেয়েছি। ওখানে বহুদিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা বারবার তাগিদ দেওয়া সত্তে¡ও তারা নিয়ম অনুসরণ করে অধ্যক্ষ নিয়োগ করেনি। এটাও বড় ধরনের অনিয়ম। এর বাইরে তারা নিয়মের বাইরে শিক্ষাথীর্ ভতির্ করায়।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে নাহিদ বলেন, ‘আমরা প্রথম যখন দায়িত্ব নিই, ১০ লাখ টাকা লাগে একজন শিক্ষাথীের্ক ভতির্ করতে! সেটা বন্ধ করার জন্য আমরা প্রভাতী সিস্টেম চালু করি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে অনুমতি পায় তার চেয়ে বেশি ভতির্ করে ফেলে। তার মানে অন্য কোনো পথে করে। আমরা শাখা অনুমোদন দিই না, দেখা যাচ্ছে তারা শাখা খুলে বসে আছে। এই তথ্যগুলো কেউ বলে না। এত ঘটনা শোনা যায় বাহ্যিকভাবে, মিডিয়ার মাধ্যমে, পত্রিকায়-টেলিভিশনে আমরা পাই, কিন্তু কোনো গাডির্য়ান বলতে চান না।’ ‘ওই প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য অভিভাবকরা আগ্রহী। সুনাম হয়ে গেছে, সামাজিক একটা স্ট্যাটাস হয়ে গেছে। এর আসল চেহরাটা উন্মুক্ত হয়েছে। আমরা এই চেহারাটা খুলে দেবো। আজ যে চেহারা প্রকাশিত হয়েছে মানুষের দৃষ্টি খুলে দেবে।’ নাহিদ বলেন, অভিযোগ ছাড়া কোনো অ্যাকশন নিতে পারি না। কেউ অভিযোগ করে না। হাইকোটের্র সুয়োমুটো হাইকোটর্ এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়মকে আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অধিকতর তদন্তের নিদের্শনা দিয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘মহামান্য হাইকোটর্ সুয়োমোটো এনেছেন, তারা নিদের্শ দিয়েছেন। আমরা এই নিদের্শ পালন করব, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে পঁাচজনের কমিটি আজকেই করে দেবো।’ ‘এটা আমাদের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, কারণ হাইকোটর্ এটা নিদের্শ দিলে আমরা করার জন্য সাহস পাই, যেটা করা উচিত সেটা করতে সক্ষম হবো। হাইকোটর্ আমাদের গাডির্য়ান হিসেবে কাজ করবে।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতা আছে আমরা পরিচালনা পষর্দ ভেঙে দিতে পারি। কাজটা ওদের করতে হবে, না করলে আমরা বাধ্য হবো। রিপোটর্ তৈরি করে হাইকোটের্র সমথর্ন নিয়ে কাজটা আমরা করতে পারব, আইনত কোনো বাধা নেই।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে