বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটের মাঠে কালোটাকার খেলা!

রিটানর্ দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা চিহ্নিত করা কঠিন সুষ্ঠু নিবার্চন হওয়ার পথে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আশঙ্কা নিবার্চনী ট্যাক থেকে ছিটকে পড়ছেন সৎ ও যোগ্য প্রাথীর্রা রাজস্ব বকেয়া রেখে নিবার্চনে অংশ নেয়ার সুযোগ
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:১০

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী আসন্ন জাতীয় সংসদ নিবার্চনে অংশ নিতে যাওয়া বিপুল সংখ্যক প্রাথীর্র হাতে নগদ জমা টাকার পরিমাণ মাত্র দুই থেকে তিন লাখ। গত ৫ বছরে তাদের আয়ের পরিমাণ যথেষ্ট কমেছে বলেও তারা নিজেরাই তাদের হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। অথচ তফসিল ঘোষণার পর থেকে এসব প্রাথীর্র অনেকে প্রচার-প্রচারণাসহ নিবার্চনকেন্দ্রিক আনুষঙ্গিক কাযর্ক্রমে প্রতিদিন ন্যূনতম ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ করছেন। আবার কারো কারো দৈনন্দিন খরচের হিসাব এরইমধ্যে এক-দেড় লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মনোনয়ন পেতেও কেউ কেউ স্বেচ্ছায় মোটা অংকের অথর্ দলীয় রাঘব-বোয়ালদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ হিসেবে ভোটের মাঠে বেশ আগেই শুরু হয়েছে কালোটাকার খেলা। যা নিবার্চনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে। দুনীির্তবাজ প্রাথীর্রা কালোটাকায় ভোট কেনার পাশাপাশি পেশিশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি অবৈধ অথের্ প্রশাসনকেও কব্জা করার চেষ্টা করছেন তারা। নিবার্চন পযের্বক্ষকদের শঙ্কা, বিভিন্ন নিবার্চনে কালো টাকার খেলা চললেও এবার তা বিগত সময়ের সব রেকডর্ ছাড়িয়ে যাবে। কালোটাকার প্রভাবে সুষ্ঠু নিবাচর্ন অনুষ্ঠিত হওয়ার পথে সৃষ্টি হবে চরম প্রতিবন্ধকতা। এবারে মনোনয়ন জমা দেয়ার সময় রিটানর্ দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়ায় এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিপুল সংখ্যক নেতা জনগণের সম্পদ লুটপাট করে অথির্বত্ত ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। যে কালোটাকা এখন তারা নিবার্চনী কাজে দেদার ব্যবহার করছেন। অথচ এ অথের্র কোনো হিসাব না থাকায় তা চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ থাকছে না। এছাড়া আয়কর বিবরণী সনদপত্রে সংক্ষিপ্তভাবে প্রাথীর্র আয়-ব্যয় ও সম্পদের বিবরণীর বাধ্যবাধকতা বাতিল করায় দুনীির্তবাজ অনেক প্রাথীর্ই সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বকেয়া রেখেও আসন্ন নিবার্চনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা। এদিকে ভোটের মাঠে কালো টাকার খেলা বন্ধে দুনীির্ত দমন কমিশন জোরেশোরে মাঠে নামার আগাম ঘোষণা দিলেও এ ব্যাপারে তারা কতটা সফল হতে পারবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। অথর্নীতিবিদদের অভিমত, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আয়কর রিটানর্ দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকায় সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদরা নানা ধরনের দুনীির্তর মাধ্যমে কী পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন তা ধামাচাপাই পড়ে থাকছে। আর তাদের সে কালোটাকা এখন নিবার্চনে খরচ হচ্ছে। যা চিহ্নিত করা দুদক কেন, রাজস্ব বিভাগের পক্ষেও অসম্ভব। এ অবস্থায় নিবার্চনী ব্যয় সীমার মধ্যে রাখতে অডিট পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের নিবার্চনে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সে ব্যাপারে সরকারি কোনো গবেষণা নেই। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, নিবার্চনী অথর্নীতির আকার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতি নিবার্চনেই এ হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ পযর্ন্ত বাড়ছে। অথর্নীতিবিদরা মনে করেন, দুনীির্তবাজ প্রাথীর্রা ঘুষ, দুনীির্ত, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাকারবারি, নামে-বেনামে ব্যাংক ঋণ এবং শেয়ারবাজারকে টাকা আয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বতর্মানে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৮ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বা ঋণ বিনিয়োগ করে অজির্ত আয়ের একটি বড় অংশ নিবার্চনে ব্যবহার হবে। প্রাথীর্রা কেউ কেউ ২৫ লাখের পরিবতের্ ২৫ কোটি টাকাও ব্যয় করবেন। খুব সীমিত সময়ে এ অথর্ ব্যয় হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। ফলে নিবার্চন শেষে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে রাজনৈতিক পযের্বক্ষকদের ভাষ্য, একজন প্রাথীর্র ভোটার প্রতি সবোর্চ্চ ৮ টাকা ব্যয় করার সীমা নিধার্রণ করা আছে। অথচ কোনো কোনো এলাকায় ভোটারপ্রতি ৫ হাজার টাকা, কিংবা তারও বেশি ব্যয় হচ্ছে। অথর্নীতির আকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই নিবার্চনে কালোটাকার বিস্তার বেড়েছে। যা নিষ্ঠাবান প্রাথীের্দর নিবার্চনী ‘ট্র্যাক’ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সুষ্ঠু নিবার্চনের স্বাথের্ পেশিশক্তি ও কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নিবার্চন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা। এ প্রসঙ্গে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিবার্চনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে সৎ ও যোগ্যপ্রাথীর্ আসবে না। এতে সুশাসন ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, নিবার্চনে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। তারমতে, ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এগুলোর পযের্বক্ষণ ও নিরীক্ষণ আবশ্যক। এজন্য অডিটর নিয়োগ করা যেতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক নাসিমা আক্তার হুসেইন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘নিবার্চনে কালোটাকার সুযোগ থাকলে তা যোগ্য প্রাথীর্র উঠে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। এ জন্য নিবার্চন কমিশন এবং সরকারের যৌথভাবে কাজ করা উচিত। যাতে কালোটাকা নিবার্চনের মাঠে ব্যবহার হতে না পারে। নিয়মকানুনের মধ্যেও এ ধরনের কোন ফঁাক ফোকর থাকা উচিত নয়। রিটানর্ দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত ছিল। এছাড়া আরও কিছু দুবর্লতার কথা উঠে এসেছে। তবে তার পরও নিবার্চন কমিশন যদি চায় তারা কালোটাকার দৌরাত্বে লাগাম টানতে পারে। তাদের সে ক্ষমতা রয়েছে। আর সেটা না হলে নিবার্চনে যোগ্য ও সৎ প্রাথীর্র বিজয়ী হওয়া কষ্টকর হবে। যা আমাদের কারো কাম্য নয়।’ তৃণমূলের রাজনীতিকরা জানান, গত সংসদ নিবার্চনে কালোটাকার তেমন ছড়াছড়ি না হলেও এবার বিরোধী দল ভোটে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় পর থেকেই এ অপতৎপরতা জেঁকে বসেছে। মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে ভোটারদের আনুক‚ল্য লাভ, ক্যাডার জোগাড়- সবখানেই প্রাথীর্রা পানির মতো টাকা খরচ করছেন। প্রাথীের্দর অনেকে সেকেন্ড কিংবা থাডর্ মিডিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের হাতে নগদ টাকা কিংবা পোশাক-পরিচ্ছদসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী পাঠালেও কেউ কেউ আবার সরাসরি নিজেই এ অপতৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন। তারা কমীের্দর মাধ্যমে ভোটারদের বিকাশ নাম্বার সংগ্রহ করে নগদ টাকা পাঠাচ্ছেন বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যদিও এ নিয়ে এখনো কোনো পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে নিবার্চন কমিশন দাবি করেছে। তবে বিএনপি দলীয় বেশ ক’জন প্রাথীর্র অভিযোগ, তারা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে অবহিত করলেও তারা তাতে গুরুত্ব দেয়নি। এ সময় ওই অভিযোগ লিখিত আকারে নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। যদিও পরে তা গ্রহণ করা হয়নি। কমিশন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ চেয়েছে। রাজধানীর একাধিক আসনের ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কালোটাকার ছড়াছড়ির ব্যাপারে সুনিদির্ষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা কেউ এ ধরনের অথর্ পাওয়ার কথা স্বীকার করেননি। তবে নগরীর একাধিক বস্তির বাসিন্দা প্রাথীের্দর পক্ষ থেকে নগদ টাকা ও শীতের কাপড়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণের তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এসব কাযর্ক্রম পরিচালনার সময় প্রাথীর্রা কেউ উপস্থিত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন বস্তির বাসিন্দারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে