বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরীর ‘উপযুক্ত পোশাক’ও নিধার্রণ করেছে পাঠ্যপুস্তক

যাযাদি রিপোটর্
  ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের প্রচ্ছদ

সাদা-কালো সালোয়ার-কামিজ আর সাদা ওড়না গায়ে এক কিশোরীর ছবি। ছবির নিচে লেখা, ‘উপযুক্ত পোশাকে কিশোরী’। এই ছবির পাশেই লেখা, ‘মেয়েরা তাদের দৈহিক পরিবতর্ন অন্যরা দেখে বিরূপ মন্তব্য করতে পারে বলে ভয়ে ভয়ে থাকে। দেহের পরিবতর্ন বেশি চোখে পড়ে বলে মেয়েরা অনেক সময় সামনে ঝুঁকে হঁাটে। উপযুক্ত পোশাক পরিধান করলে এ সংকোচ দূর করা যায়।’

২০১৯ শিক্ষাবষের্র জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোডের্র ষষ্ঠ শ্রেণির গাহর্স্থ্য বিজ্ঞান বইয়ের ‘কৈশোরকালীন পরিবতর্ন ও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা’-বিষয়ক সপ্তম অধ্যায়ে কিশোরীদের দৈহিক পরিবতর্ন নিয়ে সংকোচ দূর করতে উপযুক্ত পোশাক পরিধানের সুপারিশ করা হয়েছে।

তবে নারী, শিশু ও শিক্ষা অধিকার নিয়ে কমর্রত ব্যক্তিরা পাঠ্যপুস্তক এভাবে ‘উপযুক্ত পোশাক’ নিধার্রণ করে দিতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, একজন কিশোরীর উপযুক্ত পোশাক কোনটি, তা পাঠ্যপুস্তকে কেন থাকবে? পাঠ্যপুস্তকে অন্তভুর্ক্ত করে বিষয়টিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কতটা যুক্তিসংগত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, এভাবে কিশোরীর উপযুক্ত পোশাক নিধার্রণ করে নারীর শরীর যে একটি বাড়তি সমস্যা, তা চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে। দীঘর্ মেয়াদে কিশোরীদের মাথায়ও এটা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের বিষয় বা পাঠ্য হিসেবে অন্তভুর্ক্ত করার ক্ষেত্রে জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছে কি না, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন।

আন্তজাির্তক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের জেন্ডার উপদেষ্টা উম্মে সালমা বলেন, ‘কৈশোরকালীন পরিবতর্ন ও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা’ বিষয়ক অধ্যায়ে কিশোরীর উপযুক্ত পোশাকের বিষয়টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। এ ধরনের বিষয় উত্থাপন করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এভাবে সংকোচ দূর করা বা নিরাপত্তা দেয়ার অজুহাত একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

উম্মে সালমার মতে, রাষ্ট্র নারী-পুরুষ কারও জন্যই কোনো পোশাক নিধার্রণ করে দেয়নি। পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি থাকায় তা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বিষয়টি বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে উপযুক্ত পোশাকের মতো বিষয় অন্তভুর্ক্ত করায় আমি খুবই দুঃখিত এবং উদ্বিগ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের বিষয় থাকবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ৫০ বছরের পুরোনো চিন্তা চেতনা, মনস্তত্ত¡কে নতুনভাবে আরোপ করার চেষ্টা চলছে। জেন্ডার সংবেদনশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যসূচির বণর্নায় যে আধুনিক মনমানসিকতা ও যুক্তিবাদী চিন্তা থাকার কথা ছিল, তা এখানে অনুপস্থিত। নারী আন্দোলনের সফলতা, নারীর অগ্রযাত্রার সঙ্গে এ ধরনের বিষয় সাংঘষির্ক। তাই বিষয়টি বিশেষভাবে চিন্তার দাবি রাখে।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নিবার্হী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে কোন বিষয় থাকছে, তা থাকা কতটুকু যুক্তিসংগত, এসব দেখভালের কেউ নেই। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। গরজ নেই। অথবা বলা যায়, মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা এটি। গত বছরও এ ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম, তার মানে কোনো পরিবতর্ন হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, উপযুক্ত পোশাক নিধার্রণ করা পাঠ্যপুস্তকের কাজ নয়। পাঠ্যপুস্তকে উপযুক্ত পোশাকের মতো বিষয় রাখার মানে হলো, শুরুতেই শিক্ষাথীের্দর মস্তিষ্কের মধ্যে বিষয়টি ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়া।’

বেসরকারি সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স শিশুদের যৌন নিপীড়নের হাত থেকে সুরক্ষায় বিভিন্ন কৌশল শেখানোর কাজটি করছে দীঘির্দন ধরে। সপ্তম শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইটিতে এ সংগঠনের সুপারিশে বয়ঃসন্ধিকালের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অধ্যায়ে শিশুদের দুই দিকে হাত প্রসারিত করে এবং পা থেকে দুই হাতের মাঝের আঙুলের সঙ্গে কাল্পনিক রেখা টেনে ত্রিভুজ আকৃতির গÐিই কীভাবে শিশুদের রক্ষা করতে পারে সে কৌশল শেখানো হয়েছে।

তবে ষষ্ঠ শ্রেণির গাহর্স্থ্যবিজ্ঞান বইতে ‘কৈশোরকালীন পরিবতর্ন ও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা’-বিষয়ক অধ্যায়েই যৌন নিপীড়ন থেকে নিজেকে রক্ষায় কিশোরীদের যেসব উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে তার কয়েকটি হলো- অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া। পরিচিত ও অপরিচিত পরিবেশে একা না যাওয়া। কেউ কাছে ডাকলে কয়েক হাত দূরে থাকা। গায়ে, পিঠে হাত দিতে পারে এ রকম সুযোগ না দেয়া।

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নিবার্হী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, যৌন নিপীড়নের হাত থেকে সুরক্ষায় শিশুদের বিভিন্ন তথ্য দেয়ার পাশাপাশি কারাতে শেখানো বা বিভিন্ন কৌশলও শেখাতে হবে। আর শিক্ষাথীের্দর তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোন ভাষা ব্যবহার করে তথ্যগুলো দেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। আর যে তথ্যগুলো দেয়া হচ্ছে তা শিক্ষকেরা সঠিকভাবে পড়াতে পারছেন কি না, তা-ও দেখতে হবে। রোকসানা সুলতানা জানালেন, তারা বতর্মানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, পরিচিত ও অপরিচিত পরিবেশে একা না যাওয়াসহ অধ্যায়টিতে কিশোরীদের নিরাপত্তা রক্ষায় যেসব উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে, সে প্রসঙ্গে আয়শা খানম বলেন, ‘আমি কিশোরী অবস্থায় একা হেঁটেই স্কুলে গিয়েছি। বতর্মানে কিশোরীরা ফুটবল খেলছে। ক্রিকেট খেলছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেই তা উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর পাঠ্যপুস্তকে বলা হচ্ছে, কিশোরী যাতে একা কোথাও না যায়। এটি অত্যন্ত দুভার্গ্যজনক।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31565 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1