বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের আগুনে পুড়ছে শিশুরা!

স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হচ্ছে ঢামেকের বানর্ ইউনিট অভিভাবকদের অবহেলাকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা সতকর্ থাকার পরামশর্ চিকিৎসকদের
জাহিদ হাসান
  ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:১৮
শীত শুরুর পর প্রতিদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের বানর্ ইউনিটে আগুনে পোড়া শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে Ñফাইল ছবি

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বানর্ ইউনিটের তৃতীয় তলার ৩১৯ কক্ষ। ভেতরে ঢুকতেই ছোট্ট শিশু নুপুরের (৭) ভেজা চোখের দিকে দৃষ্টি পড়ে। চোখ থেকে এক দুই ফোটা অশ্রæ উঁকি দিতেই অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করে সে। পাশে বসে থাকা তারা বাবা রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তীব্র শীতের মধ্যে আগুন পোহাতে গিয়ে মেয়েটির শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ২৪ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভতির্ করা হয়েছে। কথা বলার সময় পাশের ওয়াডর্ থেকে অগ্নিদগ্ধ অন্য শিশুদের চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২ নম্বর বেডে থাকা দেড় বছরের শিশু সোনালী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে পাশে বসা তার মা ফেন্সি খাতুন বলেন, গোসল করার গরম পানিতে একমাত্র মেয়েটির শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ভতির্ আছেন। একই ওয়াডের্ বাম কান, হাত, গলা ও বুকসহ দেহের ১৭ ভাগ পোড়া নিয়ে অরেঞ্জ ওয়াডের্ ভতির্ দেড় বছরের আরেক শিশু তাসনিমকে ব্যথায় ছটফট করতে দেখা যায়। শিশুটির মা ছোবেরা খাতুন বলেন, দগ্ধ হওয়ার পর থেকে প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের পোড়া ক্ষত সহজে শুকাচ্ছে না। শুধুমাত্র এই নূপুর, সোনালী বা তাসনিমই নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের বানর্ ইউনিটে ভতির্ বেশিরভাগ রোগীই শীতের আগুনে পোড়া। এরমধ্যে শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অভিভাবকদের অসচেতনতা ও খামখেয়ালিতেই এমন ঘটনা ঘটছে। শীতকালীন সময়ে আগুনের প্রতি সব বয়সী মানুষেরই ঝেঁাক থাকে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ সময় আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। মফস্বল শহরগুলোতে ভালো চিকিৎসা না পেয়ে সবাই ভিড় জমায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বানর্ ইউনিটে। ঢামেক বানর্ ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার দিনে আগুনে পোড়া প্রায় দেড়’শ রোগী ভতির্ হয়েছে। যার বেশিরভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দেশে তীব্র শীত জেঁকে বসে। এ কারণে ঠাÐার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে খাবার পানি গরম করা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে আগুনের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু অসাবধানতাবশত নারী, বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুরা অগ্নিকাÐে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফলে সারাজীবনের জন্য পুঙ্গ হওয়া ছাড়াও আথির্ক ভোগান্তিতে পড়েন দগ্ধ ব্যক্তি ও তার পরিবার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করা একটি জরিপেও দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর ৬ লাখেরও বেশি মানুষ আগুনে হতাহতের শিকার হন। আক্রান্তদের মধ্যে বছরে কমপক্ষে ৩ হাজার জনের মৃত্যু হওয়া ছাড়াও শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। সরেজমিন ঢাকা মেডিকেলের বানর্ ইউনিটের আইসিইউ, এইচডিইউ ছাড়াও অন্যান্য ওয়াডর্গুলোতে গিয়ে সেখানে বিভিন্নভাবে অগ্নিদগ্ধ হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। বিশেষ করে চাইল্ড ওয়াডর্গুলোতে পুড়ে যাওয়া শিশুদেরকে তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে নীরবে চোখের জ্বল মুছতে দেখা যায় অভিভাবদেরকেও। ঢামেক বানর্ ইউনিটের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত সিনিয়র নাসর্ মেরী দ্বীপ শিখা যায়যায়দিনকে বলেন, আগুনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে শীতের মৌসুমে অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বতর্মানে ৩০০ শয্যার বিপরীতে (রোববার দুপুর পযর্ন্ত) ৫৩৭ জন পোড়া রোগী ভতির্ আছে। এর মধ্যে গত (১ তারিখ) মঙ্গলবার ৩০, বুধবার ২৫, বৃহস্পতিবার ৩০, শুক্রবার ২২ ও শনিবার ২৮ জন ভতির্ হয়েছে। বেশির ভাগই শিশু এবং উত্তরঞ্চলের জেলাসমূহ থেকে আসা রোগী। যাদের অধিকাংশরই গরম পানি, গরম তরকারি, চা ও চুলার আগুনে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। বানর্ ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, শীত মৌসুমে একটু উষ্ণতার জন্য উত্তরাঞ্চলসহ দেশের সব মানুষের মধ্যে আগুনের ব্যবহার তুলনামূলক বেড়ে যায়। কিন্তু অসচেতনতা ও আগুনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে অগ্নিদগ্ধের শিকার হন অনেকে। রোগীদের দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ অনুযায়ী এই বিভাগের রেড ইউনিটে ১১৭, বøুতে ৯৫, অরেঞ্জ ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় ৩৭ এবং তৃতীয় তলায় ১৩, গ্রিনে ৭৯ ও ইয়োলো ইউনিটে ৬৭ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য চিকৎসকরা অভিভাবকদের সচেতনতার উপর গুরুত্ব দিলেও সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের অবহেলাকেও দায়ী করেছেন তারা। এ প্রসঙ্গে ঢামেক বানর্ ইউনিটের আবাসিক সাজর্ন ডা. পাথর্ শঙ্কর পালের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত আগুনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে অসচেতনতাই অগ্নিকাÐের জন্য দায়ী। তাই গণমাধ্যমে যতই লেখালেখি হোক না কেনো মানুষ সতকর্ না হলে এ দুঘর্টনার হার কমবে না। কারণ দিন দিন বানর্ ইউনিটে রোগীর সংখ্যা না কমে বরং বাড়ছে। কি করলে আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ ইন্ডাস্ট্রিতে ঝুঁকিপূণর্ বয়লার, মেয়াদোত্তীণর্ অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডারসহ যত্রযত্র ব্যবহারের কারণে প্রায়ই বড় ধরনের দুঘর্টনা ঘটছে। অথচ সংশিষ্ট কতৃর্পক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বয়লার বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণহানি হলেও তা বন্ধে কাযর্কর পদক্ষেপ নেই। তাই নিরাপদ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি উভয় দিক থেকেই এগিয়ে আসতে হবে। আরেকটি বিষয় বিভিন্ন মহল থেকে সচেতনতার জন্য বারবার বললেও কেউ আমলে নেয় না। এজন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই ইউনিটের অন্য এক চিকিৎসক জানান, বতর্মান রান্নার কাজে ব্যবহৃত ৪০ ভাগ সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীণর্ যেগুলো থেকে মারাত্মক দুঘর্টানা ঘটতে পারে। শীত আসতেই ঘর কিংবা বাহিরে সবর্ত্র আগুন পোহানো ও শীতের পিঠা তৈরি ধুম পড়ে যায়। আবার শীতে গভর্বতী মা, বয়স্ক নারী-পুরুষ কিংবা নবজাতককে আগুনে তাপ দেয়া হয়। কিন্তু অসতকর্তাবশত দুঘর্টনা ঘটে যায়। ফায়ার সাভির্স সদর দপ্তর (ঢাকা) সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহজাহান সিকদার যায়যায়দিনকে বলেন, সাধারণত শহর ও উপ-শহরে রান্নার গ্যাসের মাধ্যমে বেশি দুঘর্টনা ঘটে থাকে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশুসহ বয়স্ক নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। কারণ তারা রান্নাঘরে ওড়না, চাদরসহ শরীরে নানা ধরনের ভারি পোশাক পরে কাজ করেন। একটু অসতকর্ হলেই কাপড়ে আগুন ধরে যায়। এছাড়া শীতের মৌসুমে হিটার ব্যবহার, চুলার ওপর কাপড় শুকানো বেড়ে যায়। রাতে বারবার গরম পানি করতে গিয়েও দুঘর্টনা ঘটে। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকের করুণ মৃত্যু ছাড়াও সম্পদ ধ্বংস হয়। যারা প্রাণে বেঁচে যান, তাদের অধিকাংশই কমর্ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ব্যবহারকারীদের সচেতনতা, ফায়ার সাভিের্সর পরামশর্, পাইপলাইন ও সিলিন্ডার গ্যাসের নিরাপদ ব্যবহার সম্পকের্ সতকর্ হতে হবে। পাশাপাশি সরকার, গণমাধ্যম, চিকিৎসক সমাজ সবাইকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংশ্লিষ্টদের সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। তবেই দুঘর্টনার সংখ্যা কমে আসবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে