শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ

উত্তাপ বাড়ছে তৃণমূল আ’লীগে

ইন্টারনেট-ডিশ লাইন ব্যবসা ফুটপাতে হকার বসানোসহ এলাকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক যেসব ব্যবসা স্থানীয় প্রভাবশালীরা এতদিন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন, নিবার্চন-পরবতীর্ সময়ে তা দখলে নিতে নতুন করে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আধিপত্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ইন্টারনেট-ডিস লাইন ব্যবসা, বাসাবাড়ির আবজর্না অপসারণ, ফুটপাতে হকার বসানো এবং অভ্যন্তরীণ সড়কে অবৈধভাবে মেয়াদোত্তীণর্ যানবাহন পরিচালনাসহ এলাকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক যেসব ব্যবসা স্থানীয় প্রভাবশালীরা এত দিন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন, নিবার্চন-পরবতীর্ সময়ে এবার তাতে নতুন করে ভাগ বসেছে। কোথাও কোথাও পুরনোদের হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকমীর্রা তা পুরোটাই নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় এ ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যবসা এতদিন বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্য কোনো দল কিংবা অরাজনৈতিক ক্যাডারদের দখলে ছিল, তাদের সরিয়ে দিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকমীর্রা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এ নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকমীের্দর মধ্যে ছোট-বড় সংঘষের্র ঘটনা ঘটেছে।

ক্ষমতাসীন দলের নবনিবাির্চত স্থানীয় সাংসদ ও বড় নেতারা বিষয়টি সামাল দেয়ার চেষ্টা চালালেও দলীয় কমীের্দর মধ্যকার এ কোন্দল থামানো তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়েছে। উভয়সংকট পরিস্থিতিতে স্থানীয় সাংসদরা অনেকেই এসব দখল-পাল্টা দখল এবং পুরনো চঁাদাবাজিতে নতুন ভাগ-বঁাটোয়ারার বিষয়টি পুরোপুরি বন্ধ রেখে আগে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার নিদের্শ দিয়েছেন। সাংসদদের কেউ কেউ আবার নিজেই এসব ব্যবসা দলের সব অঙ্গ সংগঠনের নেতাকমীের্দর মধ্যে ভাগ করে দেবেনÑ এমন প্রতিশ্রæতি দিয়ে সবাইকে ঠাÐা রাখার চেষ্টা করছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় ক্যাডাররা তা উপেক্ষা করে পেশিশক্তির মহড়ায় নেমে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিধার্রণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

ঢাকা মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের থানা পযাের্য়র একাধিক নেতার দাবি, বিএনপির শাসনামলে ডিস ক্যাবেল, ফুটপাতে হকার বসানো, বাসাবাড়ির আবর্জনা অপসারণসহ এলাকার ক্ষমতাভিত্তিক সব বাণিজ্যই ছিল তাদের একচ্ছত্র দখলে। আওয়ামী লীগের নেতাকমীের্দর কেউই তখন কোনো এলাকায় এ ধরনের কোনো ব্যবসা করতে পারেনি। অথচ তারা ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির এ শ্রেণির অধিকাংশ ব্যবসায়ী রাতারাতি ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে নিবিের্ঘœ তাদের ব্যবসা চালিয়েছেন। কেউ কেউ আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘাড়ে ভর করে এ বাণিজ্যে নিজের আধিপত্য ধরে রেখেছেন। বড় নেতারা নিজেদের পকেট ভারী করে এ সময় অন্য কাউকে এর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি। তাই এবার নিবার্চনের পর কেউ আর কোনো বড় নেতার নিদের্শনার জন্য অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করেননি। বরং যে যার মতো করে নতুন ভাগ বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ওই নেতারা।

তাদের এ বক্তব্য যে একেবারে অমূলক নয়, তা রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের নতুন ভাগাভাগির চিত্র পযাের্লাচনা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিএনপির একাধিক নেতাও এ বিষয়টি নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। রাজধানীর গোড়ান এলাকার একজন বিএনপি নেতা জানান, গত টামের্ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার ডিস ব্যবসা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে তিনি স্থানীয় যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে তার ব্যবসায়িক অংশীদার করে নেন। পরবতীের্ত তিনিই ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য ক্যাডারদের ম্যানেজ করেছেন। তবে এবার নিবার্চনের মাত্র তিন দিন পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশকিছু কমীর্ তার পুরো ব্যবসাই দখল করে নিয়েছে। বিগত সময়ে তার আশ্রয়দাতা যুবলীগের ওই নেতা তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও তাতে তিনি ব্যথর্ হয়েছেন। তবে নতুন দখলদাররা ওই ব্যবসায় তাকে কিছু ভাগ দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে বলে জানান বিএনপিদলীয় ওই ডিস ব্যবসায়ী।

এদিকে ক্ষমতাসীন দলের এক পক্ষ অনেকটা নিবিের্ঘœ ওই ডিস ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিলেও এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা আরও বেড়েছে। দলের অন্যান্য সংগঠনের নেতাকমীর্রাও তাতে নতুন করে ভাগ বসানোর চেষ্টা করছেন। বিষয়টি অভিযোগ আকারে স্থানীয় সাংসদের দরবার পযর্ন্ত গড়িয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

রাজধানীর একাধিক ওয়াডের্র কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন পযাের্য়র জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ডিস কিংবা ইন্টারনেট লাইন নয়, স্থানীয় পযাের্য় ক্ষমতাকেন্দ্রিক সব ব্যবসাতেই নতুন ভাগ বসানো নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ফের চাঙ্গা হচ্ছে। নিবার্চনের কদিন পর থেকে এ নিয়ে তাদের কাছে অহরহ নালিশ আসছে। বেগতিক পরিস্থিতি এ ঝামেলা তারা নব নিবাির্চত আওয়ামী দলীয় সাংসদদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কাউন্সিলর যায়যায়দিনকে জানান, স্থানীয় যুবলীগের কয়েকজন নেতাকমীর্ কয়েক বছর ধরে তার এলাকায় মেয়াদোত্তীণর্ সিএনজি অটোরিকশা চালানোর অবৈধ সুযোগ করে দিয়ে মোটা অংকের মাসোহারা নিচ্ছিলেন। তবে নিবার্চন-পরবতীের্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকটি গ্রæপ তাতে বাধ সেধেছেন। পরবতীের্ত পুরনো গ্রæপ এ বাণিজ্যে নতুনদের ভাগ দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এ নিয়ে তাদের মধ্যকার চাপা উত্তেজনা এখনো রয়েছে গেছে- জানান ওই জনপ্রতিনিধি।

এদিকে চঁাদাবাজি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্যে নতুন ভাগ বসানোর চেষ্টা এবং এ নিয়ে সংঘাত-সংঘষের্র ঘটনা শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ নিয়ে শুধুমাত্র বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটলেই তা শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগের নীতি-নিধার্রকদের কাছে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দঁাড়ালেও নিবার্চন-পরবতীর্ নাজুক পরিস্থিতিতে তারা কিছুটা মুখ বুজে রয়েছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা। তবে তাদের ধারণা, দলীয় স্বাথের্ই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড শিগগিরই এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নেবে।

যদিও চলমান পরিস্থিতি পযের্বক্ষণকারী গোয়েন্দাদের ধারণা, দলীয়ভাবে এ সংকট মোকাবেলা করা দুষ্কর। এ জন্য সরকারকে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেপরোয়া নেতাকমীের্দর দ্রæত লাগাম দেয়া জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শতের্ একজন গোয়েন্দা কমর্কতার্ যায়যায়দিনকে বলেন, নিবার্চনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করার পর নেতাকমীের্দর অনেকের মধ্যেই ক্ষমতার দম্ভ বেড়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় পযাের্য়র কোনো কোনো নেতা নিজেকে মহা ক্ষমতাধর ভাবতে শুরু করেছেন। যা দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দঁাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।

ওই কমর্কতার্র দাবি, গত ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে ছাত্রলীগের সাবেক উপশিক্ষা ও পাঠচক্রবিষয়ক সম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেল হত্যার নেপথ্যে চঁাদাবাজিতে নতুন ভাগ বসানোর ঘটনা রয়েছে। যা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করলেও সুরতহাল রিপোটের্ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাতে এ হত্যাকাÐ যে পরিকল্পিত ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে- যোগ করেন ওই গোয়েন্দা কমর্কতার্।

বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে ডবলমুরিং থানার ওসি এ কে এম মহিউদ্দিন বলেন, সাধারণত গণপিটুনির সময় উত্তেজিত জনতা কিল-ঘুষি-লাথি মারে কিংবা বড়জোর লাঠি দিয়ে পেটায়। কিন্তু সোহেলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো ও ছুরিকাঘাত করার আলামত দেখে তা পরিকল্পিত হত্যাকাÐ মনে হচ্ছে। এর নেপথ্যে চঁাদাবাজির ভাগ-বঁাটোয়ার বিষয়টিও রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ঘটনার মাত্র একদিন পর ল²ীপুরের রামগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে ব্যাপক সংঘষর্ হয়েছে। এতে দুই পক্ষের অন্তত পঁাচজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

স্থানীয়রা জানান, উপজেলার ৬নং লামচর ইউনিয়নের দক্ষিণ দাসপাড়া গ্রামে পানি উন্নয়ন বোডের্র (পাউবো) খালে যুবলীগের একচ্ছত্র আধিপত্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকমীর্রা ভাগ বসানোর চেষ্টা চালালে এ সংঘষের্র ঘটনা ঘটে।

এদিকে অলঙ্কার মোড় থেকে সীতাকুÐ পযর্ন্ত চলাচলকারী ৮নং রুটের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে সীতাকুÐ আসনের এমপি দিদারুল আলম দিদারের ভাগ বসানোর চেষ্টা এবং এ ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার এক শ্রমিক নেতাকে মারধরের ঘটনায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিবহন সেক্টরে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে এ ঘটনার প্রতিবাদে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় পরিবহন ধমর্ঘটের ডাক দিলে শ্রমিক ও মালিকপক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। বিভক্তি দেখা দেয় খোদ শ্রমিক সংগঠনগুলোতেও। আন্দোলন নিয়ে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে প্রকাশ পায় একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ বসানোর কারণেই এ উত্তেজনা ছড়িয়েছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতারা অভিযোগ তোলেন, শ্রমিক ফেডারেশনের নামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পঁাচ জেলায় চঁাদাবাজির বৈধতা নিতে এই পরিবহন ধমর্ঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে প্রতিপক্ষের ভাষ্য, সীতাকুÐ-৩ আসন থেকে দিদারুল আলম দিদার সাংসদ নিবাির্চত হওয়ার পর তার সহযোগীরা তার ঘাড়ে ভর করে ৮ নম্বর রুটে নতুন করে চঁাদার খাতা খুলতে চাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<32688 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1