শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ কি গণতন্ত্র থেকে ছিটকে পড়ছে?

যাযাদি ডেস্ক
  ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:১১

একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এরই মধ্যে নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নিবার্চনে অনিয়ম এবং কারচুপির অসংখ্য অভিযোগ করছেন ভোটাররা। যদিও ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এসব প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নিবার্চনের পর ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে রিপোটর্ প্রকাশ করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের নিবার্চন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে? দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ভোটের আগের রাতেই বাক্স-ভতির্ করে রাখা, ভোটারদের কেন্দ্র যেতে নিষেধ করা এবং কেন্দ্র দখল করা। ২০১৪ সালে একটি একতরফা বিতকির্ত নিবার্চনের পর ২০১৮ সালে আরেকটি বিতকির্ত নিবার্চন। এবারের নিবার্চনে যে চিত্র দেখা গেছে, সেটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনটাই মনে করছে দুনীির্তবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সংস্থাটির নিবার্হী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ‘ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পযার্প্ত পেয়েছে এটা বলা যাবে না। এ প্রশ্নটা থেকেই যাবে সবসময় যে সত্যিকার অথের্ এটা কতটা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। যদি এ ধরনের নিবার্চনটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না।’ বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নিবার্চনের ৫০টি আসনের নিবার্চনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুনীির্তবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পযর্ন্ত নিদর্লীয় সরকারের অধীনে যেসব নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে পরাজিত দল বরাবরই অভিযোগ তুললেও সাধারণভাবে সেসব নিবার্চনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে। কিন্তু ২০১৪ সালের নিবার্চনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র উল্টো পথে হঁাটা শুরু করেছে কি না সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সবের্শষ নিবার্চনের পর এ প্রশ্ন আরো জোরালো রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক পযের্বক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন মনে করেন, সবের্শষ নিবার্চনের মাধ্যমে নিবার্চনী ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাওয়ার দশা হয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের প্রথম শতর্ই পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যে নিবার্চনের বদলে এখানে কাযর্ত হয়েছে সিলেকশন। এটা গণতন্ত্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হচ্ছে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এ জন্য আমার কাছে মনে হয় যে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করার জায়গাটি ক্রমশ সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশে কাযর্করী গণতন্ত্র আছে কি না এটি নিয়ে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পশ্চিমা মাধ্যমে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৮ সালের মাচর্ মাসে জামার্ন প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোটের্ বলেছে বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদÐ পযর্ন্ত মানা হচ্ছে না। সবের্শষ নিবার্চনের পর যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হাইব্রিড রেজিমের কিছু বৈশিষ্ট্য তারা তুলে ধরেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিবার্চনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, বিরোধী দল এবং প্রাথীর্র ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা; দুনীির্তর বিস্তার প্রায় সবর্ত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুবর্ল; সিভিল সোসাইটি দুবর্ল; সাধারণত, সাংবাদিকরা সেখানে হয়রানি ও চাপের মুখে থাকে এবং বিচার ব্যবস্থাও স্বাধীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন, নিবার্চনের মান কতটা ভালো সেটির ওপর নিভর্র করে অনেক কিছু। তিনি বলেন, ‘যখন আমাদের এক-এগারো সরকার এল তখন আমাদের ওরা আর ডেমোক্রেসির ভেতরে ধরেনি। আবার ২০০৮-এর নিবার্চনের পরে আমরা ঢুকেছিলাম। তারপরে আবার ২০১৪ সালের নিবার্চন এবং এবারের নিবার্চন এমন হয়েছে যে তখন আমরা আবার প্রশ্নের সামনে পড়ছি। আমরা যদি ভবিষ্যতে একটা ক্রেডিবল ইলেকশন করতে পারি, তাহলে আমরা আবার ডেমোক্রেসির ক্লাবের মধ্যে ঢুকতে পারব।’ বাংলাদেশে এবারের নিবার্চন নিয়ে অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম সমালোচনা করেছে। নিউইয়কর্ টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে এ নিবার্চনকে প্রহসন বলে বণর্না করেছে। অন্যদিকে সিএনএন এ নিবার্চনকে বিতকির্ত হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপজ্জনক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। যদিও নিবার্চনের পর ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ বেশ দ্রæত অভিনন্দন জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্যদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা ততটা সমালোচনা করেনি, যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ইউনিভাসিির্ট সিস্টেমের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এ নিবার্চনের ফলে বহিবিের্শ্ব বাংলাদেশের ভাবমূতির্ কীভাবে দেখা হবে? তিনি বলেন ‘গেøাবাল ইমেজটা দুই ভাবে নিধাির্রত হয়। একটা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটি কিভাবে ইমেজটা নিধার্রণ করছে, আরেকটি হচ্ছে সরকারগুলো কিভাবে দেখছে। গেøাবাল সিভিল সোসাইটির কাছে নিবার্চন নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ।’ তবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে, নিবার্চনের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। এমনকি ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজেদের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান এ নিবার্চনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটা অংশগ্রহণমূলক এবং নিরপেক্ষ নিবার্চন হয়েছে। যদিও কেউ কেউ বিতকর্ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।... টিআইবি কার কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছে জানি না। এমনও তো হতে পারে তারা সাক্ষাৎকার নিয়েছে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কাছ থেকে।’ তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই ক্ষমতাসীনদের সাথে একমত নন। এ নিবার্চন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি টেস্ট কেস ছিল। কারণ গত ২৭ বছরের মধ্যে এবারই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নিবার্চন হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভালো নিবার্চন হতে পারে, এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব। তিনি বলেন, এমন নয় যে একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর ঘুরে দঁাড়াতে পারবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সে উদাহরণ আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বণর্বাদের সমস্যা কাটিয়ে দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এবারের নিবার্চনে একটি অভিনব বিষয় হলো ভোট জালিয়াতি করতে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষমতাসীনদের পাশে দঁাড়িয়েছে। এ অভিযোগ বেশ জোরালো। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নিবার্হী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটিও গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তিনি বলেন, ‘এ নিবার্চনের মাধ্যমে রাজনৈতিক চচার্য় এবং প্রাতিষ্ঠানিক চচার্য় অনেক অনৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব সুষ্ঠু নিবার্চন উপহার দেয়া, সে প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের সাথে জড়িত থেকেছে। এটা কোনো দেশের গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে বিভিন্ন সময় গ্রহণযোগ্য নিবার্চন হলেও বাংলাদেশ যে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হয়েছে সেটি বলা যাবে না। কারণ সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য গণতন্ত্রের ধারাকে শক্তিশালী হতে দেয়নি। কিন্তু এবারের নিবার্চনের গণতন্ত্রের প্রথম শতর্ই পূরণ করতে পারল না বাংলাদেশ। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে