সংসদ নিবার্চনে বিভিন্ন সংস্থার জরিপ নিভর্র প্রাথীর্ মনোনয়ন দিলেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নিবার্চনে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রাথীর্ বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল, স্বজনপ্রীতি, ও স্থানীয় নেতাদের নানা অনিয়মের কারণে তৃণমূলের মতামতে পূণর্ আস্থা রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় সংগঠন। ফলে স্থানীয় সরকারের এই নিবার্চনেও বিভিন্ন সংস্থার জরিপের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রাথীর্ বাছাইয়ে আপাতত সমস্যা সমাধান হলেও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে হলে দলীয় প্লাটফমের্ক শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খেঁাজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে দেশি-বিদেশি ১০/১২টি সংস্থা দিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের খেঁাজ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব সংস্থার রিপোটের্র পাশাপাশি দলীয় জরিপের সমন্বয় করে প্রাথীর্ মনোনয়ন দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত খুব একটা প্রাধান্য পায়নি। তাই শক্তিশালী সংগঠন গড়তে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নিবার্চনে প্রাথীর্ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত নেয়র উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বধির্ত সভার মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রাথীর্ তালিকা কেন্দ্রে পাঠাতে নিদের্শ দেয়া হয়। এরইমধ্যে সারা দেশ থেকে সম্ভাব্য প্রাথীের্দর তালিকা জমাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরইমধ্যে এই তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা তৃণমূলের দেয়া তালিকা পরিবতর্ন করে নিজেদের পছন্দের প্রাথীের্দর নাম পাঠিয়েছে কেন্দ্রে। আবার কোথাও বধির্ত সভাকে ঘিরেই বিভক্ত হয়ে পড়ে নেতাকমীর্রা। একই উপজেলায় পাল্টাপাল্টি একাধিক বধির্তসভা করে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের অনুসারীরা। আবার অনেকই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরামশর্ না করেই প্রাথীর্ তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন উপজেলায় স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, দলীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিয়েছে। ফলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র আসা তালিকা বিশ্বাস করতে পারছেন না শীষর্ নেতারা। তাই আবারও বিভিন্ন সংস্থার জরিপের মাধ্যমে প্রাথীর্ বাছাইয়ের কথা ভাবছেন তারা। আওয়ামী লীগের শীষর্ পযাের্য়র একাধিক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নিবার্চনের তফসিল ঘোষণার পর পরই আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কাযার্লয় থেকে দলটির প্রতিটি সাংগঠনিক জেলায় প্রাথীের্দর নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘দলের গঠনতন্ত্রের ২৮(৪) ধারা মোতাবেক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামশর্ গ্রহণ করে জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের (৪ জন) স্বাক্ষরে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রাথীর্ অথবা অনধিক ৩ জনের একটি প্রাথীর্ তালিকা ৬ ফেব্রæয়ারির মধ্যে কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।’ তালিকার সঙ্গে প্রাথীের্দর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিও পাঠাতে বলা হয় ওই চিঠিতে। কিন্তু বেশিরভাগ জেলা এবং উপজেলায় কোনো রকম আলাপ-আলোচনা বা নিবার্চন ছাড়াই পছন্দের প্রাথীের্দর নাম কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীষর্ নেতারা। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও দলীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তারা। অনেক জেলায় আবার বিত্তশালী প্রাথীর্রা টাকার বিনিময়ে জেলা ও উপজেলার নেতাদের ম্যানেজ করে নিজেদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। তৃণমূল নেতাদের মনোনয়নবাণিজ্যের ফলে তৃণমূলে জনপ্রিয়তা থাকলেও অনেক জনপ্রিয় প্রাথীর্র নাম আসেনি কেন্দ্রে। তাদের কেউ কেউ এসব বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। অনেকে আবার ভয়ে চিঠি না পাঠিয়ে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি এবং অফিসে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সূত্রমতে, উপজেলা নিবার্চনের প্রাথীর্ মনোনয়নকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে দুই শতাধিক অভিযোগ দলীয় সভানেত্রীর ধানমÐি কাযার্লয়ে জমা পড়েছে। এসব অভিযোগে থেকে জানা গেছে, উপজেলা ও জেলা থেকে পাঠানো তালিকায় বাদ পড়েছেন মাঠের জনপ্রিয়, সৎ ও দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ প্রাথীর্রা। এমপি-মন্ত্রী ও জেলা নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন বতর্মানে দায়িত্বরত প্রায় অধর্শত উপজেলা চেয়ারম্যান। তালিকায় স্থান পেয়েছেন এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন ও হাইব্রিড নেতারা। এমন অবস্থায় অভিযোগগুলো তদন্ত করার কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব অভিযোগ তদন্ত করে তৃণমূলের নামের সঙ্গে কেন্দ্রের জরিপের সমন্বয় করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা। তৃণমূলের অভিযোগ : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় কোনো ধরনের বধির্ত সভা বা ভোটের ব্যবস্থা না করেই প্রাথীর্ তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে বলে দলীয় সভানেত্রীর কাযার্লয়ে জমা দেয়া হয়েছে। যাতে ১৮৭ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। ওই তালিকায় নাম আসেনি দলের যোগ্য প্রাথীর্রা। বাদ পড়েছেন বতর্মান চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমানও। এ প্রসঙ্গে আশরাফুর রহমান বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের বধির্ত সভা না ডেকেই খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে প্রাথীর্ তালিকা করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।’ একইভাবে পিরোজপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খালেকের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়নি। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথভাবে কেন্দ্রে নাম পাঠানোর নিয়ম থাকলেও সাধারণ সম্পাদক এককভাবে কেন্দ্রে নাম পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে জেলা সভাপতি পৃথকভাবে ওই চেয়ারম্যানের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ‘তৃণমূলে ভোট গ্রহণের নিয়ম থাকলেও কোনো ধরনের ভোট ছাড়াই প্রাথীর্র নাম পাঠানো হয়েছে। তৃণমূলে আমার জনপ্রিয়তা থাকলেও ব্যক্তিগত আক্রোশে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি এরশাদের আমলে দুবার, এক-এগারোর সময় একবার জেল হাজতে ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। নীলফামারী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিটলার চৌধুরী ভুলু লিখিত অভিযোগে বলেন, বধির্ত সভা ডেকে তিনজনের নাম পাঠানোর কথা থাকলেও তা না করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভুয়া রেজুলেশন দেখিয়ে কেন্দ্রে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেছেন। পরে সৈয়দপুর উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাকে দলীয় মনোনয়ন দিতে কেন্দ্রে প্রত্যয়নপত্র পাঠিয়েছেন। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায় প্রাথীর্ বাছাইয়ে অনিয়মের অভিযোগ জানিয়েছেন শাহ মাহাবুব মোকশেদ কাঞ্চন ও খায়রুল কবির খোকন নামে দুই আওয়ামী লীগ নেতা। তারা লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, সবার মতামত উপেক্ষা করে একজন ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একজন দুনীির্তবাজ ও বিতকির্ত ব্যক্তির নাম এককভাবে জেলায় পাঠানো হয়েছে। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলায় চেয়ারম্যান পদের জন্য যে তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে দুজনের বিষয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য লিখিত ওই অভিযোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন, আসন্ন উপজেলা নিবার্চনে খানসামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আযম চৌধুরী এবং শহিদুজ্জামান শাহকে যেন দলীয় মনোনয়ন না দেয়া হয়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগড়ায় প্রাথীের্দর নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপির সুপারিশকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নামমাত্র বধির্ত সভা করে কোনো নিবার্চন ছাড়াই এমপি তার পছন্দের প্রাথীের্দর নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, আমরা স্থানীয় নেতারা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে প্রাথীের্দর নাম দিয়েছি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোডের্র একাধিক সদস্য জানান, উপজেলা নিবার্চন নিয়ে সারাদেশ থেকে তাদের কাছে নানা অভিযোগ আসছে। বড় দল হওয়ার কারণে অনেকেই নিবার্চন করতে চান, সে কারণে অভিযোগও আসছে বেশি। তবে তৃণমূলের সুপারিশ করা নামের ভিত্তিতেই প্রাথীর্ চূড়ান্ত করা হবে না। প্রাথীর্ চূড়ান্তের ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে পাঠানো নাম, আওয়ামী লীগের নিজস্ব জরিপ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপকে আমলে নেয়া হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোডর্ উপজেলা নিবার্চনের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ চূড়ান্ত করবেন। এ প্রসঙ্গে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, তৃণমূল থেকে নাম পাঠানোর সময় কেউ কোনো অনিয়ম করল কিনা, সেটা দেখবে আমাদের মনোনয়ন বোডর্। আমরা যাচাই-বাছাই করেই দলীয় মনোনয়ন দেব। শুধু তৃণমূলের নাম থাকলেই চলবে না, দলীয় ও বিভিন্ন সংস্থার জরিপ প্রতিবেদনে জনপ্রিয় হলেই তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। এখানে যোগ্যরাই মূল্যায়িত হবেন। জনপ্রিয়দের প্রাথীর্ করা হবে।’ পরপর তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা দলটি যদি সব নিবার্চনে নানা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রাথীর্ বাছাই করতে থাকে তাহলে দিন দিন সংগঠন দুবর্ল হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একজন শীষর্ নেতা নাম প্রকাশ না করার শতের্ যায়যায়দিনকে বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শক্তি হলো তৃণমূলের নেতাকমীর্। দলীয় প্রাথীর্ মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তার প্রতিফলন না ঘটলে সংগঠন মজবুত হবে না। একটি দল সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবে না। কখনো ক্ষমতার বাইরে গেলে এসব সংস্থার প্রতিবেদনই কাল হয়ে দঁাড়াতে পারে। নিজেদের কমীর্ দিয়ে সংগঠন পরিচালনা করতে হবে। নেতাকমীর্ হলো দলের প্রাণ। তাই তাদের কিভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায় সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে এভাবে শত বছর ক্ষমতায় থাকলেও মৌলিক জায়গায় দলের কিছু অজির্ত হবে না বলে জানান তিনি।