বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরগাছা হটানোর চ্যালেঞ্জে শাসকদল

আশ্রয়দাতা দলীয় নেতাদের দ্রæত চিহ্নিত করার তাগিদ অভিযুক্ত কাউকে ছাড় না দিতে হাইকমান্ডের হুশিয়ারি খেঁাজা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় মাচের্র মধ্যেই তালিকা তৈরি করবে গোয়েন্দারা
সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর জামায়াত-শিবির ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সুবিধাবাদী নেতাকমীর্ রাতারাতি ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করেছে। কোথাও কোথাও তারা ত্যাগী নেতাদের হটিয়ে দিয়ে দলের পদ-পদবিও বাগিয়ে নিয়েছেন। এতে দলের সক্রিয় নেতাকমীর্রা অনেকে স্বেচ্ছায় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ চাপে পড়ে দলের সাংগঠনিক কাযর্ক্রম থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে সংগঠনের মূল ভিত কিছুটা দুবর্ল হয়ে পড়েছে। অথচ দলে অনুপ্রবেশকারী বহিরাগতরা বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অনেক অপকমের্র কারণে দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিক্ত এ অভিজ্ঞতায় তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পরপরই দলীয় হাইকমান্ড থেকে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগ নেতাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে।

দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, অনুপ্রবেশকারীদের হটানোর বিষয়টি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। সিনিয়র কোনো নেতাও অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয়দাতা হলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে নাÑ দলীয় হাইকমান্ড এ ব্যাপারে সবাইকে আগেভাগেই হুশিয়ার করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী অবৈধ সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে এরই মধ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জোরেশোরে মাঠে নেমেছে। তারা আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং পদ-পদবি কী ছিল তা খুঁজে দেখা দেখছে। এ ছাড়া এসব অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে স্থানীয় থানা কিংবা অন্য কোথাও কোনো রাজনৈতিক মামলা আছে কিনা গোয়েন্দাদের তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কোন নেতা, কীভাবে এসব অনুপ্রবেশকারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কী ধরনের অপকমের্ তারা দলের নাম ভাঙাচ্ছেন এবং তা থেকে তারা কতটা অবৈধ সুবিধা নিচ্ছেন, তা সবিস্তারে জানানোর জন্য গোয়েন্দাদের নিদের্শ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে দলীয় কোনো নেতার শেল্টারে কোনো চঁাদাবাজ-সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। আগামী মাচের্র মধ্যে মাঠ পযার্য় থেকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরে জমা হবে। সেখান থেকে সমন্বিত প্রতিবেদন পাঠানো হবে দল ও সরকারের নীতিনিধার্রক পযাের্য়।

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পযাের্য়র এক কমর্কতার্ নাম প্রকাশ না করার শতের্ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পরই দলে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের পাশাপাশি বিরোধী দলীয় সুবিধাবাদী নেতাকমীর্র অনুপ্রবেশ ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া যারা আগেই নানা কৌশলে দলটিতে ঢুকে গেছে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। সে নিদের্শনা অনুযায়ী অনুপ্রবেশকারী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রথমসারির একজন নেতা বলেন, ‘সাধারণত এ দেশে কোনো দল সরকার গঠন করলে অনেক সুবিধাবাদী সরকারি দলে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালায়। এ ধরনের বণের্চারা কেউ যাতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে ঘাপটি মেরে থাকতে না পারে সেজন্য দলীয় হাইকমান্ড এ সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি দলের তৃণমূল পযাের্য়র নেতাকমীের্দর এ ব্যাপারে সতকর্ থাকতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অন্য দল থেকে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে যারা পদ দখল করে আছে তাদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সদস্য পদ নবায়নের সময় বাদ দেয়া হবে। পরগাছাদের দলে প্রবেশ ঠেকাতে নতুন সদস্য নেয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করা হবে। এই অনুপ্রবেশকারীরাই বিভিন্ন সময় দলের মধ্যে থেকে অপকমর্ করে দলের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের হটানোর চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে দলটির প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক যায়যায়দিনকে বলেন, একটি দল পরিচালনা বা সরকার পরিচালনা করা কখনোই কুসুমাকীণর্ নয়। দেশি-বিদেশি ও আঞ্চলিকসহ নানা চ্যালেঞ্জ, ষড়যন্ত্র থাকবেই। এগুলোর ব্যাপরে দল সজাগ ও সতকর্ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের নীতিনিধার্রণী পযাের্য়র একাধিক সূত্র জানায়, সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় নিবার্চনের আগে স্থানীয় পযাের্য় দলীয় অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল সম্পকের্ পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জোগাড় করতে গিয়েই মূলত দলে অনুপ্রবেশকারীদের দাপটের বিষয়টি উন্মোচিত হয়। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে উঠে আসে, বিরোধী পক্ষের জনপ্রিয়তায় নয়, বরং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই আওয়ামী লীগ বিপদে পড়তে পারে।

কেননা মন্ত্রী-এমপি ও স্থানীয় পযাের্য়র অনেক নেতাই নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে দলে অনেক ‘পরগাছার’ আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের কারণেই দলে ত্যাগী ও দুঃসময়ের নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অথচ ২০০৯ থেকে ২০১৮ পযর্ন্ত বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কত সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকমীর্ ও ক্যাডার ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তার কোনো তথ্য নেই দলের কারো হাতে। দলে অনুপ্রবেশকারীদের পদ-পদবি পাওয়ার বিষয়েও নেতাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো চিত্র নেই। এমনকি তাদের দাপটে কোথায় কতজন ত্যাগী নেতা দল থেকে ছিটকে পড়েছেন তার খতিয়ানও এলোমেলো। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে দলে অনুপ্রবেশকারী ও তাদের আশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও নিবার্চনী নাজুক পরিবেশ তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, যা নিবার্চন-পরবতীর্ দ্রæত কাযর্কর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী মাচর্ থেকে ধাপে ধাপে উপজেলা নিবার্চন শুরুর আগেই দলে অনুপ্রবেশকারী পরগাছাদের হটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কেননা তা না হলে তারা নিজেদের স্বাথের্ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আওয়ামী লীগের ভেতরে নতুন করে নানা কোন্দল সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে দলীয় প্রাথীর্ নিবার্চনের ক্ষেত্রে তাদের উস্কানিমূলক আচরণের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ বিষয়টিতে এখন সবোর্চ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

দলের প্রভাবশালী এক নেতা জানান, স্থানীয় পযাের্য় যে যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, যার সঙ্গে দলের ত্যাগ নেতাকমীের্দর সখ্য নেই এবং যিনি দলে অনুপ্রবেশকারীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাকে কোনোভাবেই উপজেলা নিবার্চনী দলীয় প্রতীক দেয়া হবে না। এ নিয়ে কেউ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালালে, তাদের ব্যাপারে দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওই নেতার ভাষ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ই বলে দিয়েছে দেশের মানুষ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শরিক হতে কতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাই ব্যক্তি বিশেষের কোনো অপচেষ্টায় দলের কোনো ক্ষতি হবে না বলে মনে করেন তিনি।

তবে রাজনৈতিক পযের্বক্ষকদের ধারণা, গত ১০ বছরে যেভাবে বানের পানির মতো আওয়ামী লীগে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাতে নতুন করে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। কেননা পদ-পদবি নিয়ে দীঘর্ সময় ধরে দলে শক্ত নিয়ে অবস্থানে থাকায় অনুপ্রবেশকারীদের অনেকে এখন ‘বড় আওয়ামী লীগার’ হয়ে উঠেছেন। এছাড়া দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তারা এতটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে, এখন তাতে তাদের আলাদা করা সত্যিকার অথের্ই কঠিন হবে। পরগাছাদের সরাতে মূল গাছে বড় ধরনের নাড়া লাগবে বলে মনে করেন তারা।

রাজনৈতিক পযের্বক্ষকদের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, দলের অনেকে তা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছে। নাম প্রকাশ না করার শতের্ তা আওয়ামী লীগের স্থানীয় পযাের্য়র একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে যারা দলে অনুপ্রবেশ করেছেন, তারা এতদিন বড় নেতা হয়ে গেছেন। এসব অনুপ্রবেশকারীও এখন ‘পরগাছা’ হটানোর উদ্যোগে জোরালো (!) ভূমিকা নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও দলীয় মন্ত্রী-এমপি ও জেলা পযাের্য়র নেতারা তাতে সায় দিচ্ছেন।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, একাদশ সংসদ নিবার্চনে বিএনপির প্রাথীর্র পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সময় আওয়ামী লীগের থানা পযাের্য়র এক নেতা স্বস্ত্রীক পুলিশের হাতে আটক হলেও দলীয় নেতারাই তাদের ছাড়িয়ে আনেন। পরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বরং ওই নেতাকে আওয়ামী লীগের নতুন থানা কমিটিতে রাখার জন্য তালিকার প্রথমদিকে নাম রাখা হয়েছে। যা নিয়ে স্থানীয় নেতাকমীের্দর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36080 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1