শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাল দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনায় বৈধ সেবা!

জরিপ হয়, উদ্ধার হয় না উচ্ছেদ করতে গেলে দলিল ও মামলা নিয়ে হাজির হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া ঢাকার খাল উদ্ধার প্রায় অসম্ভব
ফয়সাল খান
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:১৬
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর খাল ভরাট করে এভাবে নিমার্ণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি ও সড়ক। ছবিটি রূপনগর এলাকা থেকে তোলা Ñফাইল ছবি

২০১৬ সালে সুনিদির্ষ্ট করে ঢাকার খালগুলোতে ২৪৮ জন দখলদার চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসন। ২০১৭ সালে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও জলাশয় নিয়ে জরিপ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। প্রায় প্রতি বছরই জলাশয় ও ড্রেনের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালায় ঢাকা ওয়াসা। এসব জরিপে ঢাকার খাল বিলীন ও ভরাট হয়ে যাওয়ার চিত্র ফুটে উঠে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী অবৈধ দখল থাকলেও এসব জায়গায় ভবন নিমার্ণ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ বৈধ সেবা দিয়ে যাচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলো। ফলে খালগুলো উদ্ধার করা দিন দিন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। রাজধানীর খাল ও জলাশয় নিয়ে দীঘির্দন ধরে গবেষণা করছেন পানি উন্নয়ন বোডের্র সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, দেশের সাবির্ক অব্যবস্থাপনা ও দুনীির্তর প্রভাব খালের উপর পড়েছে। জরিপ হতে পারে, তালিকা হতে পারে কিন্তু এগুলো উদ্ধারের সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো খালের জায়গায় বড় অট্টালিকা গড়ে তোলা হয়েছে। তারা ট্যক্স দিচ্ছে। উচ্ছেদ করতে গেলে কোনো না কোনো উপায়ে একটি কাগজ (জমির বিভিন্ন কাগজ ও দলিল) নিয়ে হাজির হয়। আদালতের কাছে যায়। ফলে চাইলেই এত বড় বড় স্থাপনা ভেঙে খাল উদ্ধার করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যারা তালিকা তৈরি করে অবৈধ স্থাপনা বলছে, তারাই এসব জায়গায় স্থাপনা নিমাের্ণর অনুমতি দিয়েছে। বিভিন্ন বৈধ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, রাজধানীতে বহুতল ভবন নিমার্ণ করতে গেলে রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষসহ বেশ কিছু সংস্থার অনুমোদন লাগে। বিভিন্ন খালের জায়গায় বড় স্থাপনা নিমাের্ণর অনুমতিও দিয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। তাছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো বৈধ সেবাও দিচ্ছে অনেক সংস্থা। আবার কোথাও কোথাও খালের জায়গায় মাকের্ট তৈরি করে অবাধে ব্যবসায় পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ের জন্য সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্সও দিয়েছে। তবে সংস্থার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা দেয়ার বিষয়টি খাল দখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। যদি কেউ রাজউকে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে ভবন নিমার্ণ করে, সেখানে গ্যাস, পানি বা অন্যান্য সুবিধা দেয়া দোষের কিছু না। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, খাল উদ্ধারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হাইকোটর্ থেকে যেভাবে নদী দলখকারীদের নিবার্চনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে যদি খাল দখলের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো উদ্যোগী হয় তবেই রাজধানীর খাল উদ্ধার করা সম্ভব। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সব দখলদাররাই প্রভাবশালী এবং দেশের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক সেলটার ছাড়া কেউ জলাশয় দখল করতে পারে না। তাই এসব দখলদারদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। সংস্থাগুলো খাল দখল করে স্থাপনা নিমার্ণ করাকে অবৈধ বললে হরহামেশায় বৈধ সেবা দেয় কিভাবে এমন প্রশ্নও তুলেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. অদিল মুহাম্মদ খান যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকার খাল উদ্ধারে সরকারের বাতার্ এখনো অস্পষ্ট। কেননা একদিকে অবৈধ বলে অন্যদিকে তাদেরকে বৈধ সেবা দিয়ে যাচ্ছে সংস্থাগুলো। এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া খাল উদ্ধার সম্ভব নয়। অবৈধভাবে দখলকৃত খালের জায়গায় বৈধ অনুমোদন ও সেবা দেয়ায় অনেকই দখল করতে উৎসাহিত হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। তবে খালগুলো দখলমুক্ত করতে না পারার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীসহ সরাদেশে যারা খাল, নদীসহ বিভিন্ন জলাশয় দখল করে অবৈধ স্থাপনা নিমার্ণ করেন, তারা সবাই প্রভাবশালী। প্রশাসনও তাদেরকে বসে আনতে পরেন না। এমনকি অভিযান পরিচালনা করতে গেলে নানা হুমকি-ধমকির মুখে পড়তে হয়। বেশ কয়েকবার রাজধানীর জলাশয় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকারী একজন ম্যাজিস্ট্রট যায়যায়দিনকে বলেন, অভিযানের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই নানা মহল থেকে তদবির আসতে থাকে। এমন লোকজন তদবির করেন, যা সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। সবকিছু উপেক্ষা করে অভিযানে গেলে নিজের জীবন ও পরিবারের উপর হুমকি আসে বলে জানান তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন সময় দখলকৃত জায়গার কগজপত্রও তৈরি করে নিয়েছেন অনেকেই। তাই ঢাকার খাল বা খালের জায়গা উদ্ধার করা সহজ হবে না। খেঁাজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার ২৬ খালেই প্রায় ৫০০ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলকার ২২টি খালের মধ্যে প্রবাহ আছে মাত্র তিনটির। এমনও খাল আছে যেখানে পানি প্রবাহ তো দূরে থাক একটু গতর্ও নেই। এসব খাল ভরাট করে সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, মাকের্ট ও রাস্তাসহ নানা স্থাপনা। কয়েক বছর ধরে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা খালের উপর জরিপ চালালেও এসব জলাশয় ভরাটের পেছনে এসব সংস্থার উদাসীনতা ও সহযোগিতাও রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশ না করার শতের্ সরকারি একটি সংস্থার জরিপ পরিচালনাকারি টিমের প্রধান যায়যায়দিনকে বলেন, খালের জায়গা দীঘির্দন দখলে থাকার কারণে অনেকেই ভুয়া দলিল তৈরি করে নিয়েছে। খাজনা দিচ্ছে। নিজ নামে রেকডর্ করে নিয়েছে। আরএস, সিএস রেকডর্ও তাদের নামে। এসব খাল উদ্ধারে অভিযানে নামলেই দখলদাররা শত শত মামলা নিয়ে হাজির হবে। তাই ঢাকার খাল উদ্ধার করা কঠিন। সেনাবাহিনীকে খাল উদ্ধারের দায়িত্ব দিলে, তা সহজ হবে বলেও মনে করেন তিনি। এদিকে, ঢাকা ওয়াসার এক তালিকায় দেখা গেছে, ২৬টি খালে প্রায় ৫০০ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এরমধ্যে কঁাটাসুর খালে বিভিন্ন ধরনের ৭৭টি, রামচন্দ্রপুর খালে ৩৭টি, বেগুনবাড়ী খালে ২০টি, বাসাবো খালে দুটি, শাহজাদপুর খালে ৪টি, আব্দুল্লাহপুর খালে ৭টি, সেগুনবাগিচা খালে ১০টি, মহাখালী খালে ২৩টি, ইব্রাহিমপুর খালে ৩৬টি, কল্যাণপুর প্রধান খালে ২৬টি, কল্যাণপুর-খ খালে ৩৮টি, কল্যাণপুর-ঘ খালে ১২টি, কল্যাণপুর-ঙ খালে ১৪টি, কল্যাণপুর-চ খালে ১৯টি, জিরানী খালে ১৫টি এবং হাজারীবাগ খালে ১১৭টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এর বাইরেও বেশকিছু অস্থায়ী স্থাপনা রয়েছে। এরমধ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা স্থাপনা নিমার্ণ করা হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই খালগুলোর মালিকানা বুঝে নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটির একটি সূত্র বলছে, এই খালগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ করার জন্য ১২শ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। এরমধ্যে খালের সীমানা নিধার্রণ, ময়লা আবজর্না পরিষ্কার করা, প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা অন্তভুর্ক্ত রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ওয়াসার এক প্রকৌশলী জানান, সব কাজই করা যাবে। তবে উচ্ছেদে গেলেই শত শত মামলা নিয়ে হাজির হবে দখলদাররা। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এসব খাল দখলমুক্ত করা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান তিনি। সরেজমিন রাজধানীর খিলগঁাও-বাসাবো খালের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খিলগঁাও রেলগেট ফ্লাইওভার সংলগ্ন ফানির্চার দোকানগুলোর সামনে খিলগাঁও-বাসাবো খালের নাম সংবলিত ঢাকা ওয়াসার একটি ফলক রয়েছে। এতে খাল দখলমুক্ত রাখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কথা লেখা রয়েছে। তবে ফলকটির আশপাশের কোথাও খালের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালটি ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন। খালটি খিলগঁাওয়ের ভেতর দিয়ে বাসাবো হয়ে মান্ডা খালের সঙ্গে সংযোগ ছিল। ঢাকা জেলা পরিষদের যে তালিকায় ঢাকার খালে ২৪৮টি দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে ওই তালিকায় বলা হয়েছে, মিরপুর সাকেের্লর বাউনিয়া খালের একাংশ ভরাট করে ফেলেছে রাজউক। একইভাবে আবদুল্লাহপুর খাল এবং দিয়াবাড়ি খালের কিছু অংশও ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দিয়াবাড়ি খালের ভরাট অংশ রাজউকের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ঢুকে গেছে। এ বিষয়ে রাজউক কতৃর্পক্ষ বলছে, প্রকল্পের কাজের সময় খাল বোঝা যায়নি। তাই বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। এখন ওয়াসার সঙ্গে এ বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। এর পরিবতের্ নতুন করে খাল খনন করে দিবে রাজউক। তাছাড়া ত্রিমোহনী-নন্দীপাড়া খালের উপর মাকের্ট নিমার্ণ করেছিল জেলা পরিষদ। পরে অবশ্য সিটি করপোরেশনের অভিযানে মাকের্টটি ভাঙ্গা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে