শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে বাংলাদেশে স্থায়ী তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা

যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০৮
ধমর্প্রাণ মুসল্লিদের গুরুত্বপূণর্ অনুষঙ্গ টুপি। বিশ্ব ইজতেমাস্থলে তাই নানা কারুকাজের টুপি বিক্রি করছেন এক ব্যবসায়ী Ñযাযাদি

রাজধানী ঢাকার ঠিক লাগোয়া উত্তর দিকে টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় শীতের সময়টায়। সাধারণত ডিসেম্বরের কিংবা জানুয়ারি মাসে এই জমায়েত বাংলাদেশে হয়ে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরেÑ লাখ লাখ মানুষ এতে অংশ নেন, যাদের মধ্যে বিদেশীদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। সবচেয়ে বড় ধমীর্য় জমায়েত হজের পর এই বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় জমায়েত। এর গোড়াপত্তন হয় ভারতে, কিন্তু পরবতীর্ সময়ে এটা অধর্শতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে হয়ে আসছে। বাংলা পিডিয়ায় দেয়া তথ্য বলছে, ‘১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ:) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলিগি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলিগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে এবং উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে। ‘১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সূত্র ধরে উপমহাদেশের ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূবর্ পাকিস্তানÑএ তিনটি অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থান সাপেক্ষে তাবলিগের তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক এবং লেখক এ কে এম খাদেমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘১৯২০ সালের দিকে যখন এটি শুরু হয়েছিল তখন এটা একটা আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল ভারতে।’ তিনি বলেন, ‘একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা শুরু হয়েছিল। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধমর্ থেকে যারা অন্য ধমের্ চলে যাচ্ছিল তাদের আবারও হিন্দু ধমের্ ফিরিয়ে নেয়ার একটা চেষ্টা ভারতবষের্ বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়।’ ‘এটা একটা প্রক্রিয়া যেটাকে আন্দোলন বলা যায়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তখন দেওবন্দকেন্দ্রিক মুসলমানেরা চিন্তা করলেন মুসলমানদের ইসলাম সম্পকের্ আরো সচেতন করে তুলতে হবে। এটাকে আন্দোলন বলা হয়, এই অথের্ যখন একটা গোষ্ঠী অনেক লোক নিয়ে একটা নিদির্ষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত করে তখন সেটা আন্দোলনের রূপ নেয়’। খাদেমুল হক বলেন, যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন ব্রিটিশরা ভারতবষর্ শাসন করছে। তাবলিগ জামাত কখনোই নিজেদের ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে প্রচার করতে চায়নি। ইজতেমার বাংলাদেশ পবর্ শুরু যেভাবে : বাংলাদেশে এর সূত্রপাত হয় চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে। চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর দিয়ে হজে যাওয়ার জন্য মানুষ সেখানকার হজ ক্যাম্পে জড়ো হতেন, আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আঞ্চলিক ইজতেমার প্রক্রিয়াটা। বাংলাদেশে প্রথম তাবলিগের জামাত নিয়ে আসেন তাবলিগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ করছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর মোহাম্মদ ইউসুফ দুই দেশেই জামাত পাঠানো শুরু করলেন ইজতেমা আয়োজনের জন্য। তবে তখন ছোট আকারে ইজতেমা হতো। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ‘১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার রমনা পাকের্র কাছে কাকরাইল মসজিদÑযেটা সে সময় মালওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত ছিলÑ সেখানে এই সম্মেলনটা হয়। এরপরে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে’। বাংলাদেশ যখন পূবর্ পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন ১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি জামাত আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মো. খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বতর্মানে তাবলিগ জামাতের শূরা কমিটির একজন উপদেষ্টা। এখন যেভাবে বিদেশ থেকে প্রচুর মুসলমান ইজতেমায় অংশ নেন, সেই সময়ে অবশ্য অন্যান্য দেশ থেকে লোকজন আসেনি বলে জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিল, আর ছিল গ্রামের মানুষ’। ঢাকার পর মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন। খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বলেন, তাবলিগের জমায়েতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এর পরের বছর অথার্ৎ ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। এর পরের বছর ঠিক করা হয় ইজতেমা হবে টঙ্গীর তুরাগ নদের কাছে। আরো পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীতেই ১৬০ একর জমি নিধার্রণ করে দেন ইজতেমার জন্যÑ জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। বিশ্ব ইজতেমা নাম কীভাবে হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ব ইজতেমা’ তাবলিগের দেয়া নাম নয়, বরং তাবলিগের লোকজন এটাকে বাষির্ক সম্মেলন বলতেন। খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বলেন, ‘তাবলিগ জামাতের পক্ষ থেকে বিদেশীদের পাঠানো শুরু হয় এক সময়। ‘যখন বিদেশ থেকে লোক আসা শুরু করল, তখন গ্রামের লোক এটাকে বিশ্ব ইজতেমা বলা শুরু করল। শূরার একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, জনগণের চাহিদার ওপর আল্লাহতায়ালা বিশ্ব ইজতেমা করে দিয়েছেন।’ ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নাম নিয়ে তাবলিগ জামাতের মধ্যেই শুরুতে বিতকর্ ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্ব ইজতেমা নামটি প্রচলিত হয়ে যায়। কেন বাংলাদেশ বিশ্ব ইজতেমা ইজতেমার ধারণা শুরু হয়েছিল ভারতে। ভারত ভাগের পর পূবর্ পাকিস্তানে ইজতেমা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশে না হয়ে বাংলাদেশেই স্থায়ী হয়েছে। খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বরেন, ‘এর একটা কারণ ছিল সে সময়ে বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া সহজ ছিল। ইজতেমার নামে কেউ ভিসা আবেদন করলে কেউ ফেরত যেত না। এটা সরকারের একটা ভালো পলিসি ছিল।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এই ইজতেমাকে সমথর্ন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষক এবং লেখক একেএম খাদেমুল হক বলেন, দুটো কারণে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে হয়েছে। ‘একটি বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। আরেকটি তাবলিগ জামাতের যে আন্দোলন সেটা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক। যদিও ভারতে এর শুরু কিন্তু ভারতে মুসলিম-প্রধান দেশ না হওয়ার কারণে অনেক দেশের মুসলিমরা সে দেশে যেতে কমফোটর্ ফিল করেননি। আবার পাকিস্তানকে নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে।’ খাদেমুল হক আরও বলেন, তাবলিগের জমায়েত বাংলাদেশে শুরু থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যতটা পেয়েছে ততটা ভারত বা অন্য কোথাও পায়নি। এছাড়া সবচেয়ে কম খরচে মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারত। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হওয়ার পিছনে কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ভারতের কিছু স্থানে তখনো মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ ছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশে মুসলমানদের শান্তিপূণর্ সহাবস্থান ছিল, যাকে একটা নিরাপদ পরিবেশ বলে মনে করেছিলেন তারা। তবে তিনি এও বলেন, তাবলিগের এক সম্মেলনে ইজতেমার স্থান হিসেবে লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে বলে অনেকে উল্লেখ করেন। অবশ্য এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান। ভারত এবং পাকিস্তানÑএই দুইটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক নিরপেক্ষ একটা স্থান ছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়, রাজনৈতিক কারণে তখন ভারতের নাগরিকরা যেমন সহজে পাকিস্তানে যেতে পারতেন না, তেমনি পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভারতে যাওয়া ছিল কঠিন একটি বিষয়। ফলে বাংলাদেশই ছিল ওই দেশ যেখানে সহজে সবাই আসা-যাওয়া করতে পারতেন বলে গবেষকরা মনে করেন। তবে তাবলিগের ইজতেমা যে বিশ্বের অন্য কোথাও হচ্ছে না তা নয়। পাকিস্তানের রাইবেন্ড এবং ভারতের ভোপালে বড় আকারে ইজতেমা হয় বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমার ঠিক আগে ও পরে। তবে যে সংখ্যায় বিদেশীরা বাংলাদেশের ইজতেমায় আসেন, তাতে করে তুরাগ তীরের ইজতেমাই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে