বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
আজ সাদপন্থিদের ইজতেমা শুরু

আখেরি মোনাজাতে শেষ একাংশের বিশ্বইজতেমা

মোনাজাতে আমিন, আমিন ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান
আবুল হোসেন, গাজীপুর ও রেজাউল কবির রাজিব, টঙ্গী
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৩৩
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্বইজতেমার ময়দানে শনিবার সকালে লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে প্রথম পবের্র আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় Ñফোকাস বাংলা

মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় ঐক্য, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি, দেশের কল্যাণ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শনিবার শেষ হলো তাবলিগ জামাত আয়োজিত ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমার মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের পবর্। বিশেষ তাৎপযর্পূণর্ এ আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রহমত প্রাথর্না করা হয়। এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মহামহিম ও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান। মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীষর্স্থানীয় মুরব্বি কাকরাইল মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা মুহাম্মদ জোবায়ের। তিনি আরবি ও বাংলা ভাষায় মোনাজাত পরিচালনা করেন। সকালে দিক-নিদের্শনামূলক বয়ানের পর লাখ লাখ মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে বেলা ১০টা ৪০ মিনিটে। জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দঁাড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। কান্নায় বুক ভাসান তারা। ২৪ মিনিটব্যাপী মোনাজাতে মাওলানা জোবায়ের প্রথম ১৩ মিনিট মূলত পবিত্র কোরআনে বণির্ত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ১১ মিনিট দোয়া করেন বাংলা ভাষায়। মুঠোফোন ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের আরও লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। অনেকে বিমানবন্দর গোল চত্বর কিংবা উত্তরা থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। এদিন রাজধানী ঢাকা ছিল প্রায় ফঁাকা। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, মাকের্ট, বিপণিবিতান, অফিসসহ সবকিছু ছিল বন্ধ। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা ইজতেমায় মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের আখেরি মোনাজাতের আগে শনিবার সকাল থেকে হেদায়েতী বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খোরশেদ। তার বক্তব্য বাংলায় তরজমা করছেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। হেদায়েতী বয়ান শেষে বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জোবায়ের প্রথম পক্ষের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। এদিকে ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে শনিবার সকালে চার দিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি হেঁটেই টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা স্থলে পেঁৗছেন। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূণর্ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পেঁৗছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। শনিবার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পাশ্বর্বতীর্ বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ। সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন শুরু হবে সেই কাক্সিক্ষত আখেরি মোনাজাত। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৩-৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠঁাই ছিল না। ময়দান ছেড়ে যাচ্ছেন জোবায়ের অনুসারীরা ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে শনিবার মধ্য রাতের মধ্যে মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করার কথা জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান। শনিবার আখেরি মোনাজাতের পর রাত ১২টার মধ্যে পুরো মাঠ খালি করে পুলিশ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়। রোববার সকাল ৭টার পর মাওলানা সাদ অনুসারীরা মাঠে প্রবেশ করবেন বলে জানিয়েছেন কমিশনার। শনিবার সকালে সাংবাদিকদের সাথে ইজতেমা মাঠে নিমির্ত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এসব কথা বলেন কমিশনার। মুসল্লিদের প্রস্থান এবং প্রবেশ নিয়ে যাতে কোনো রকমের বিশৃৃঙ্খলা না হয় সেদিকে পুলিশের সতকর্ অবস্থান রয়েছে। ইজতেমা মাঠে আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু টঙ্গীর বিশ^ ইজতেমায় আগত আরও তিন মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। শনিবার ভোরে ঢাকার কদমতলা এলাকার মো. আবুল হোসেন (৫৫) ইজতেমা ময়দানে তার নিজ খিত্তায় ভোর ৫টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান। ইজতেমা মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরার পথে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এক মুসল্লি মারা গেছেন। তার নাম আব্দুল আউয়াল (৫৬), তার বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি থানার রুলজানী গ্রামে। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর আগে শুক্রবার দুপুরে আব্দুর রহমান (৫৫) নামে আরও এক মুসল্লি মারা যান। তিনি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মৃত হাতেম আলীর ছেলে। ইজতেমা মাঠে জানাজা শেষে তাদের লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী ৭জন মুসল্লি মারা গেলেন। ইজতেমা মাঠের লাশের জিম্মাদার আদম আলী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ২০২০ সালের বিশ^ ইজতেমা জানুয়ারিতে দুই পবের্ হবে ২০২০ সালের বিশ^ ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের আখেরি মোনাজাতের পর মাইকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ইজতেমার শীষর্ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ২০২০ সালে দুইপবের্ বিশ^ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রথম ধাপ হবে ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হবে ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি। মাঠে প্রবেশ করলেন সা’দ অনুসারী মুসল্লিরা বিশ^ ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে মাওলানা জোবায়ের অনুসারী মুসল্লিগণ ময়দান ত্যাগ করার পর বিকালে সা’দ অনুসারী শীষর্ মুরুব্বিরা ময়দানে প্রবেশ করেন। নজমে জামাতের মুরুব্বিরা সেখানে মঞ্চ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক বিষয় তদারকি করবেন। মাওলানা সা’দ অনুসারী মাওলানা সৈয়দ আনিসুজ্জামান জানান, রোববার ভোরে ইজতেমার মুসল্লিগণ ময়দানে আসতে শুরু করবেন। প্রশাসনের লোকজন সকালের মধ্যে ময়দান তাদের কাছে বুঝিয়ে দেবেন। তার পর ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। ইজতেমা ছাড়লেন আল্লামা শফী হেফাজত ইসলামীর আমির আল্লামা আহমদ শফী আখেরি মোনাজাত শেষে শনিবার দুপুরে ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করেছেন। গাজীপুর সিটি মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, শুক্রবার দুপুরে আল্লামা আহমদ শফী ইজতেমায় যোগ দিতে চট্টগ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে টঙ্গীর বিশ^ ইজতেমা ময়দানে আসেন। শনিবার মোনাজাত শেষে তিনি বেলা সোয়া দুইটার দিকে হেলিকপ্টার যোগে ফের চট্টগ্রামে ফিরে যান। বাংলায় মোনাজাতে তুষ্ট মুসল্লিরা বাংলায় মোনাজাতে অংশ নিতে পেরে বাংলা ভাষা-ভাষী মুসল্লিরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গাজীপুরের ভোগড়া থেকে আখেরি মোনাজাতে যোগ দিতে আসা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দীঘির্দন ধরে বিশ^ ইজতেমার মোনাজাতে অংশ নিচ্ছি। আমি উদুর্-আরবি বুঝি না। আগে ওইসব ভাষায় পরিচালিত মোনাজাতের কথা বুঝতে পারতাম না। সকলের সঙ্গে শুধু আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন বলতাম। গতবার থেকে মোনাজাত বাংলায় হওয়ায় এর মোনাজাতের মমর্ বুঝতে পেরেছি। এজন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। মোনাজাতে অতিরিক্ত মাইকের ব্যবস্থা বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পবের্র আখেরি মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ও গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। এর মধ্যে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ইজতেমা ময়দান থেকে আবদুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পযর্ন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেলস্টেশন, স্টেশন রোড থেকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের অলিগলিতে পযার্প্ত মাইক সংযোগ দেয়া হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মোনাজাতে অংশগ্রহণ বিশ^ ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর সিটি কপোের্রশনের মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, হেফাজত ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা মোনাজাতে অংশ নেন। বিদেশি মেহমান ৬ শতাধিক এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ কমপক্ষে ৫২টি দেশের তাবলিগ জামাতের ছয় শতাধিক বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মোনাজাত শেষে জনজট ও যানজট আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লিরা তাড়াহুড়া করতে শুরু করেন। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী- কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীঘর্ জনজট ও যানজট। রাত ১২টার মধ্যে ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করতে হবে সে জন্য ময়ানের ভিতরে অবস্থানকারী মুসল্লিরাও বের হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা আখেরি মোনাজাতের দিন ইজতেমা ময়দানের আশপাশের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এতে দুটি খাবার হোটেল ও দুটি গাড়ির চালককে সংশ্লিষ্ট আইনে চারজনকে ২৫ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া টঙ্গী স্টেশন এলাকায় ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে দুইজনকে একমাস করে কারাদÐ এবং অপর একজনকে ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে