বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজিল্যান্ডের মসজিদে রক্তের বন্যা

জুমার নামাজে সন্ত্রাসী হামলায় তিন বাংলাদেশিসহ নিহত ৪৯ অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা
যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৬ মার্চ ২০১৯, ০০:৩৪
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। ছবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিস্নদের রক্তাক্ত কাপড়, জুতা ও টাকা -ইন্টারনেট

রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদ। সেখানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জনে পৌঁছেছে। নিহত লোকজনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি। তাদের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হামলায় কমপক্ষে ২০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। হামলা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। হামলাকারী অস্ট্রেলীয় নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ চারজনকে আটক করেছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ। বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে একটি গাড়ি থেকে। নিউজিল্যান্ডের কোথাও কোনো মসজিদে মুসলিমদের যেতে নিষেধ করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে মসজিদগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। শহরজুড়ে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসলমানদের ওপর হামলা চালান ওই বন্দুকধারী। পরে কাছাকাছি শহরতলি লিনউডের মসজিদে হামলা চালানো হয়। তবে দ্বিতীয় মসজিদে হামলাকারী একই ব্যক্তি কি না, তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও মতে, হামলাকারী একাধিক ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যারডের্ন এ ঘটনার নিন্দা প্রকাশ করে বলেছেন, এ ঘটনা নিউজিল্যান্ডের জন্য ঘোর অমানিশা। জেসিন্ডা অ্যারডের্ন টুইটে বলেছেন, 'ক্রাইস্টচার্চে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার জায়গা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী সম্প্রদায়ের। নিউজিল্যান্ডেই তাদের বাড়ি। তারা আমাদের লোক।' মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ : নিউজিল্যান্ড পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জন হয়েছে। তবে হামলাকারীর যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ওই হামলাকারী আছেন কি না, তা নিশ্চিত করেনি পুলিশ। স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ মৃতের সংখ্যা বাড়ার তথ্য জানান। তিনি বলেন, ভয়াবহ হামলার ঘটনায় ৪৯ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক ব্যক্তিরা ছাড়াও আর কেউ হামলায় জড়িত ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দুইটি ঘটনাস্থল থেকেই কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে মাইক বুশ বলেছিলেন, বন্দুকধারীর হামলায় গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে। তবে এখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাসিন্দাদের ক্রাইস্টচার্চ সড়ক দিয়ে চলাচলে নিষেধ করা হয়েছে এবং পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের না হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিহত তিন বাংলাদেশি শনাক্ত সিডনি থেকে প্রথম আলোর নিয়মিত লেখক কাউসার খান স্থানীয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নিহত দুই বাংলাদেশির পরিচয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাকে এ তথ্য দেন ক্রাইস্টচার্চের ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ চৌধুরী। ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থল-সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন। তিনি জানান, নিহত একজনের নাম ডা. আবদুস সামাদ, তার স্ত্রী সানজিদা আক্তার। অপরজন গৃহবধূ হোসনা আরা পারভীন ফরিদ। নিহত হোসনার স্বামীর নাম ফরিদ। নিহত তিনজনই ক্রাইস্টচার্চে বহু বছর ধরে বাস করছিলেন। ড. মেসবাহ জানান, ঘটনার পর থেকেই আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নিখোঁজ বলে শোনা গেছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। এর আগে অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সুফিউর রহমান জানান, আল নুরসহ দুটি মসজিদে হামলার ঘটনায় নিহত লোকজনের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি রয়েছেন। রক্ষা পেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা মসজিদটি হ্যাগলি ওভাল মাঠের কাছাকাছি হওয়ায় জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা অনুশীলন শেষে সেখানে নামাজ আদায়ের জন্য যাচ্ছিলেন। অনুশীলনে লিটন দাস ও নাঈম হাসান ছাড়া দলের অন্য সবাই ছিলেন। ক্রিকেট দল মসজিদে প্রবেশের মুহূর্তে সেখানে হামলার ঘটনা ঘটে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হামলা হয়েছে জানিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে ক্রিকেট দলকে নিষেধ করলে খেলোয়াড়রা দ্রম্নত সেখানে থেকে ফিরে আসেন। এ ঘটনার পর ক্রিকেটার তামিম ইকবাল টুইটে জানান, এটা তাদের জন্য 'ভীতিকর অভিজ্ঞতা' ছিল, বন্দুকধারী সেখানে হামলা চালিয়েছিল। তামিম টুইটে লেখেন, 'পুরো দল বন্দুকধারীর হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এটা ভীতিকর অভিজ্ঞতা। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।' বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মুখপাত্র জালাল ইউনুস বলেছেন, দলের বেশির ভাগ সদস্য মসজিদে যাওয়ার জন্য বাসে চড়েছিলেন। মসজিদে প্রবেশের মুহূর্তে হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলার পর ক্রিকেট দলের সদস্যদের হোটেল থেকে বের না হতে বলা হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠে শনিবার বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। পরে ম্যাচটি বাতিল করা হয়। হামলাকারী অস্ট্রেলীয় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, হামলাকারী কট্টর ডানপন্থী। তবে তার নাম প্রকাশ করেননি তিনি। স্কট মরিসন বলেন, ক্রাইস্টচার্চে একজন উগ্র মনোভাবের অধিকারী ডানপন্থী উন্মত্ত জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া নাগরিক। তবে তিনি বিস্তারিত আর কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তদন্ত করছে। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীর নাম ব্রেনটন ট্যারেন্ট। বয়স ২৮ বছর। তিনি অভিবাসীবিরোধী কট্টরপন্থী। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন জানিয়েছেন, হামলাকারী নিরাপত্তা নজরদারির তালিকায় ছিল না। হামলার ভিডিও ভাইরাল ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পরপর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এতে দেখা গেছে, ভিডিও গেমের মতো একজন বন্দুকধারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করছেন। হামলার ভিডিও দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বন্দুকধারী হামলার আগে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। হয়তো তার মাথায় ভিডিও ক্যামেরা বসানো ছিল। একটি ওয়েবসাইট জানায়, হামলাকারী হামলাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করেছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে, হামলাকারী স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। মসজিদের প্রবেশকক্ষ থেকেই মুসলিস্নদের ওপর নির্বিচারে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করেন। মসজিদের ভেতর ছোটোছুটিরত মুসলিস্নদের প্রতি টানা গুলি করতে থাকেন। এরপর মসজিদের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরে ঘুরে গুলি করতে থাকেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা মসজিদের মেঝেতে পড়েছিলেন, তাদের দিকে ফিরে ফিরে গুলি করছিলেন তিনি। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর তা ভয়াবহ উলেস্নখ করে অনলাইনে না ছড়াতে লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ। চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ দুই মসজিদে হামলার ঘটনার ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া গেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী ফিলিস্তিনি জানান, তিনি একজনকে মাথায় গুলি করতে দেখেছেন। তিনি বলেন, 'আমি পরপর দ্রম্নত তিনটি গুলির আওয়াজ পাই। ১০ সেকেন্ড পর আবার গুলি শুরু হয়। এটা অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হবে। তা না হলে কোনো মানুষের পক্ষে এত দ্রম্নত ট্রিগার টানা সম্ভব নয়। লোকজন দৌড়াতে শুরু করে। কারও কারও দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।' তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালিয়ে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নামাজ আদায়রত অবস্থায় তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি দৌড়ে মসজিদ থেকে পালিয়ে এসে দেখেন তার স্ত্রী ফুটপাতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি শিশুদের গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন। তিনি বলেন, চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। এই হামলার আগে আরেকবারও বিশ্ব শিরোনামে উঠে এসেছিল নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের শহর ক্রাইস্টচার্চের নাম। ছোট্ট এই শহরটিতে ২০১১ সালে আঘাত এনেছিল ভূমিকম্প। ওই সময় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শহরের ঐতিহ্যবাহী ক্যাথেড্রাল (গির্জা) ভূমিকম্পে ধসে পড়ে। সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, নিউইয়র্ক টাইমস, নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড, স্টাফ ডট কো ডট এনজেড শেখ হাসিনার শোকবার্তা নিউজিল্যান্ডের দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় বহু মানুষ হতাহতের ঘটনায় শোক ও নিন্দা প্রকাশ করে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চে ওই হামলার ঘটনার পর শেখ হাসিনার তরফ থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ'ডুর্নকে ওই বার্তা পাঠানো হয়। ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বন্দুকধারীদের গুলিতে অন্তত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে দুই বাংলাদেশিও রয়েছেন। 'নজিরবিহীন' এ ঘটনাকে 'সন্ত্রাসী হামলা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ'ডুর্ন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে