প্রায় ১৫ মাস নিখোঁজ থাকার পর গত শনিবার নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। তবে তিনি কোথায়, কি অবস্থায় ছিলেন এবং ফিরলেন কিভাবে- এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত ১টার দিকে মারুফ জামান একা একাই তার ধানমন্ডির বাসায় ফিরে আসেন। বাড়ির ম্যানেজার তাকে দেখতে পেয়ে ওপরে নিয়ে যান। এ সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন বলে জানা গেছে।
মারুফ জামানের মেয়ে শনিবার তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাবার ফিরে আসার খবরটি নিশ্চিত করলেও এ বিষয়ে আর কিছু জানতে না চাওয়ার অনুরোধ করেন। এমনকি পুলিশের সঙ্গেও এখন কথা বলছেন না তারা।
এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, 'মারুফ জামানের মেয়ে আমাদের জানিয়েছেন, তার বাবা ফিরে এসেছেন। তাদের ভবনের ম্যানেজার তাকে দেখতে পেয়ে বাসার ভেতর নিয়ে আসেন।' মারুফের মেয়ে তার বাবার সঙ্গে কাউকেই এখন পর্যন্ত দেখা করতে দেননি। তাই তিনি কিভাবে ফিরেছেন, কোথা থেকে এসেছেন, কে দিয়ে গেছেন- কোনো কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।
ওসি আবদুল লতিফ বলেন, 'মারুফ জামানের খোঁজ নিতে আমার দুইজন লোক ওনার বাসায় গেলে তার মেয়ে বলেছেন, উনি অসুস্থ। কোনো কথা বলবেন না। একটু সুস্থ হওয়ার পর কথা বলবেন।'
মারুফ জামান কিছু জানালে যদি কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকে, তাহলে পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে জানান ওসি আবদুল লতিফ।
আশার আলো দেখছেন
নিখোঁজদের পরিবার
২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মারুফ জামান নিজ বাড়ি থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন।
এরও চার বছর আগে জাতীয় নির্বাচনের সময় আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিলেন সাজেদুল ইসলাম নামে বিএনপির এক সংগঠক।
গত ছয় বছর ধরে প্রিয়জনের খোঁজ না পেলেও মারুফ জামানের ফিরে আসায় নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে সাজেদুলের পরিবারে।
তবে হাইকোর্টের রুল জারি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ভাইয়ের সন্ধানে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ জানান নিখোঁজের বোন সানজিদা ইসলাম।
তিনি বলেন, 'এটা আমাদের জন্য আশা যে, ১৫ মাস পর যদি মারুফ জামান ফিরে আসেন, তাহলে নিখোঁজ অন্যরাও ফিরতে পারেন।'
'আমরাও ভাইয়ের সন্ধানের দাবিতে অনেক সংবাদ সম্মেলন করেছি। মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, তারা দেখবেন। কিন্তু তারা কোনো তদন্ত করেনি।'
কেন তারা নীরব?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ৩১০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ফেরত এসেছেন।
তবে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের সঙ্গে কি ঘটেছিল সে ব্যাপারে প্রায় কেউই মুখ খোলেননি।
রাষ্ট্রযন্ত্র ও আইনি কাঠামোর ওপর আস্থাহীনতাই এই নীরবতার বড় কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী এবং গুম পরিস্থিতির গবেষক নূর খান।
তিনি বলেন, 'রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না, যার কারণে তারা ছাড়া পাচ্ছেন এবং যারা তাদের আটক করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।'
এ ছাড়া এত দীর্ঘ সময় কাউকে আটক রাখা কোনো দুষ্কৃতকারী দলের পক্ষে সম্ভব নয় উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'এটা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা অনেক শক্তিশালী এবং নির্দেশিত পন্থায় কাজ করে।'
এ পর্যন্ত যারা ফিরে এসেছেন, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন নূর খান।
তিনি জানান, প্রত্যেকের বক্তব্যে এটাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তাদের এমন জায়গায় রাখা হতো, যেখানে সাধারণ মানুষের চলাচলের সুযোগ নেই এবং আটককারীরা প্রশিক্ষিত গ্রম্নপের সদস্য।
তবে তারা এ কথাগুলো প্রকাশ্যে আনতে চান না, আরেকটি বিপর্যয় ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কায়।
গুম ঠেকাতে কী প্রয়োজন
তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ফিরে আসা প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাগুলো সামনে আনা জরুরি বলে মনে করেন মানবাধিকার-কর্মী সুলতানা কামাল।
যেসব আশঙ্কা ও হুমকির কারণে এই মানুষগুলো মুখ খুলতে ভয় পান, সেই ভয় দূর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও জোরাল ভূমিকা নেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
সুলতানা কামাল বলেন, 'এর আগে যারা হারিয়ে গিয়েছিলেন, পরে ফিরে এসেছেন, তাদের কাছে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম, এর মধ্যে একটি উত্তর এমন ছিল যে, ছেলেমেয়ের ওপর যখন হুমকি আসে তখন মুখ খোলা কঠিন। তার মানে নিশ্চয়ই তাদের এমনই কোনো শর্ত দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। যার জন্য তারা মুখ খুলতে ভয় পান।'
'কিন্তু এটা আমি মনে করি, তাদেরও একটা দায়িত্ব জানানো যে, কি হয়েছিল না হয়েছিল। তাহলে আমরাও হয়ত এটা সুরাহা করার একটা পথ পেতাম। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তারাই বা এটার সুরাহা করেন না কেন?'
নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনের অভিযোগ, তারা প্রিয়জনের খোঁজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলেও এখনো কোনোটির তদন্ত শুরু করা হয়নি।
এমন অবস্থায় প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে।