মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
চিকিৎসকদের বাণিজ্য!

অহেতুক ভিটামিন সেবনে দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

রোগীদের অজ্ঞতা এবং চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে ভিটামিন সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। এতে উপকারের পরিবর্তে মানব দেহের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে
জাহিদ হাসান
  ২৩ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রোগীদের অজ্ঞতা এবং চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের ব্যণিজ্যিক মনোভাবের কারণে ভিটামিন সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। এতে উপকারের পরিবর্তে মানব দেহের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ দেহের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিমাণ ভিটামিন যা পাওয়া যায় সুষম খাদ্য থেকে। কিন্তু প্রতিদিনের ব্যস্ততায় সঠিক ডায়েট নিয়ন্ত্রণ না করা এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের অনভ্যস্ততায় অনেকেই ভিটামিন জাতীয় ওষুধকে প্রাধান্য দেন। ঘাটতি পূরণে মুঠো-মুঠো অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণ করেন। অথচ প্রায় সব ভিটামিনেরই একটি টক্সিক মাত্রা আছে যা অতিরিক্ত সেবনে ব্যক্তির অজান্তেই তার শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধে। কিন্তু অনেক অভিভাবক শিশুর দ্রম্নত বৃদ্ধি, তরুণ-তরুণীরা চুলপরা রোধ, ত্বকের উজ্জ্বলতা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ সেবন করান। অথচ মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ফাইল সেবনের মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীর কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা অন্তত ১০০ জন রোগীর প্রেসক্রিপশন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর সাপিস্নমেন্টারি মেডিসিন হিসেবে ভিটামিন সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোনো সমস্যা নিয়ে যে কেউ তাদের কাছে আসলে শারীরিক দুর্বলতার দিকটা বেশি বর্ণনা করেন। তখন অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন বা সাপিস্নমেন্টারি মেডিসিনের পরামর্শ দেয়া হয়। সাময়িক উপকারিতায় অনেকে দীর্ঘ মেয়াদে এসব ওষুধ সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মেডিকেল প্রতিনিধি (রিপ্রেজেন্টেটিভ) যায়যায়দিনকে বলেন, বিষয়টির জন্য অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মনোভাব দায়ী। কারণ চিকিৎসকের ব্যক্তিগত (পরিবারের) ব্যবহারের জন্য প্রতিটা কোম্পানি বিশেষভাবে তৈরি স্যাম্পল ওষুধ উপঢৌকন দেয়। স্যাম্পল গ্রহণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ভিটামিন জাতীয় ওষুধকে বেশি প্রাধান্য দেন। ফলে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন সাপিস্নমেন্ট প্রেসক্রাইবেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এদিকে অতিরিক্ত ভিটামিনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে চিকিৎসকরা বলছেন, ভিটামিন- এ মানুষের দেহে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে দৃষ্টিশক্তি ও স্নায়ুর কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপায়ী ব্যক্তি ভিটামিন- এ বেশি খেলে লাং (ফুসফুস) ক্যানসারের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া শরীরে শক্তি জোগানো ও রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন বি-৬ কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে এটি দিনে ১০০ মিলিগ্রামের বেশি খেলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষয়, ত্বকে তীব্র ব্যথা অনুভব, বমিবমি ভাব, বুকে জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন-হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ভিটামিন-ই ক্যাপসুল খান। তাদের হৃদযন্ত্র বিকল, ক্যানসার আক্রান্ত ও অকালে মৃতু্যর ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন- ডি একত্রে গ্রহণের ফলে রক্তে এর মাত্র বেড়ে গিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনিতে পাথরসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইভাবে অতিরিক্ত ফলিক এসিড সাপিস্নমেন্ট গ্রহণে কোলন ক্যানসার, সেলেনিয়ামের ফলে প্রোস্টেট ক্যানসার ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস, জিংক সেবন ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে থাকে। ভিটামিন- সি, ফ্লোরাইড ও অল ইন ওয়ান হিসেবে পরিচিত মাল্টি-ভিটামিনে সাময়িকভাবে উপকার হলেও দীর্ঘমেয়াদি সেবনে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনস্বাস্থ্যবিদ (সহযোগী অধ্যাপক) যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে দেশের বাজারে ১ হাজার ৪৫৮টি জেনেরিক নামের ২৮ হাজার ৬৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ৬০ থেকে ৭০ হাজার নিবন্ধিত যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক এগুলো প্রেসক্রাইব করছেন। সারাদেশে এক লাখের অধিক লাইসেন্সধারী ওষুধ ব্যবসায়ী ও প্রায় আড়াই লাখের মতো ফার্মেসি তা বিক্রি করছেন। এর মধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ২০০ কিছু বেশি মডেল ফার্মেসি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেশে ওষুধের ফার্মেসির সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিকার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব যায়যায়দিনকে বলেন, রোগীর প্রয়োজনে চিকিৎসকরা ওষুধ বা ভিটামিন লিখবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু রোগের নামে ওভার প্রেসকিশন করাটা অন্যায়। অনেক সময় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ভিটামিন যা শিশু বা বৃদ্ধদের লাগতে পারে। তবে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে ফুড সাপিস্নমেন্টের নামে কিছু ওষুধ লিখে থাকেন এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এ জন্য দেশে এ জাতীয় ওষুধ আনতে না দেয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, কোনো চিকিৎসক লিখলে বিএমডিসির মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিএসএমএমইউ এর উপাচার্য (উন্নয়ন ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. শহিদুলস্নাহ সিকদার যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে মাল্টিড্রাগ রেজিসট্যান্স বা এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ছে। এখন মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ বা ভিটামিন জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসকদেরকেও ভিটামিন জাতীয় ওষুধের নিরাপদ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কারণ ভিটামিনের ঘাটতির কারণে যেমন সমস্যা হয় তেমনই অতিরিক্ত গ্রহণেও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে চিকিৎসকদের সহায়তা নিয়ে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ওষুধ মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ কমিটির নজরদারি বাড়াতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে