মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্যে বিষে দিশেহারা মানুষ

বিজ্ঞাপন ও সচেতনতামূলক পোস্টে সীমাবদ্ধ কার্যক্রম সময়বিশেষ স্বল্প পরিসরে ভেজালবিরোধী অভিযান জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে নিষ্ক্রিয় অনেকে খাদ্যের গুণগত মান যাচাইয়েও উদ্যোগ নেই
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
রাজধানীতে ভেজার বিরোধী অভিযান -ফাইল ছবি

ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন বেকারিজাত পণ্যের পর এবার দুধেও বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি ধরা পড়ায় দেশের মানুষ এখন দিশেহারা। বিশেষ করে যেসব পরিবারে শিশু সদস্যের আধিক্য রয়েছে তারা রীতিমতো চোখে অন্ধকার দেখছেন। শিশু সন্তানের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে তাকে কি খাবার খাওয়াবেন, দুধের বিকল্প কি হবে, বিষাক্ত কোন খাবার তার শরীরের জন্য কতটা ক্ষতির - এসব জানতে তারা চিকিৎসকসহ নানা জনের কাছে ছুটছেন। বিষাক্ত খাদ্যে গর্ভজাত সন্তান বিকলাঙ্গ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে এ আশঙ্কায় সন্তানসম্ভবা নারীসহ তাদের গোটা পরিবার চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। অথচ নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো সেমিনার,র্ যালি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতামূলক পোস্ট এবং স্বল্প পরিসরে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে।

এমনকি খাদ্যপণ্যের গুণগত মান ঠিক আছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্যও মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো কার্যক্রমই নেই। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ জনবল সংকটের দোহাই দিচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন, মাঠপর্যায়ের কাজ তাদের নয়, কেবল বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করাই তাদের দায়িত্ব।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, খাবারে ভেজাল ও বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রণকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করলেও এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ খুবই সীমিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নতজানু ভূমিকা পালনেরও সুস্পষ্ট নজির রয়েছে। যা ভেজালকারীদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। খাদ্যে ভেজালকারীদের চিহ্নিত না করে বরং জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রশাসন দায় সারছে। এ অবস্থায় উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভেজাল এবং বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ঘটছে। যার ফলে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও দেশীয় খাদ্যপণ্যের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরইমধ্যে বেশকিছু খাদ্যপণ্য বিদেশে রপ্তানি বন্ধও হয়ে গেছে। তবে মান নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যপণ্য দেশে দেদার আমদানি হচ্ছে বলেও জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ফ্রান্সের ল্যাকটালিস কোম্পানির শিশুর ফর্মুলা দুধে 'সালমোলেনা এগোনা' নামক ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়ার খবর বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ১৪ ডিসেম্বর 'বেবীমিল্ক ফর্মুলা'-সম্পর্কিত সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দেশের বাজারে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে কিনা, সে খোঁজ তখন নেয়নি সংস্থাটি।

ওই সময় এ প্রসঙ্গে খাদ্য নিরাপদ কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমরা শিশুখাদ্যে 'সালমোলেনা এগোনা' জীবাণু পাওয়ার খবর পাওয়ার পর বিজ্ঞাপন দিয়েছি। পাশাপাশি বাংলাদেশে এই দুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিয়েছি বিক্রি না করতে। তবে বাজারে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে কিনা, তার খোঁজ নেয়া হয়নি।' জনবল সংকটের কারণে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নেয়া সম্ভব না বলে দাবি করেন খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

অন্যদিকে খাদ্য নিরাপদ সংস্থাটির সচিব মো. খালেদ হোসেন বলেন, 'অভিযান পরিচালনা বা মাঠপর্যায়ে কাজ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বিজ্ঞাপন ও কর্মশালা করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।'

তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে এ ধরনের কার্যক্রম নেহাৎ গোঁজামিল ও দায়সারা বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, খাদ্যপণ্য কোনটি ভেজাল এবং কোন খাবারে কি ধরনের বিষাক্ত পদার্থ কতখানি আছে তা শনাক্ত করা সাধারণ ভোক্তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। এমনকি খোদ উৎপাদনকারীও অনেক সময় এ ব্যাপারে অন্ধকারে থাকেন। তাই খাদ্যে ভেজাল ও বিষ শনাক্ত করার দায়িত্ব সরকার তথা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। এ অবস্থায় তারা শুধু জনসচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হলে সাধারণ ভোক্তারা কেবল বিষাক্ত ও ভেজাল দ্রব্য তাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবে। এর বেশি আর তেমন কোনো লাভ হবে না।

তাদের এ যুক্তি যে অমূলক নয়, তা সম্প্রতি দুধে বিষাক্ত পদার্থ থাকার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন দুগ্ধ খামারের কাঁচা দুধ বিক্রেতা এবং পাস্তুরিত দুধ কোম্পানির সেলস্‌ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে সম্প্রতি যে চিত্র পাওয়া গেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তারা জানান, গত ১০ ফেব্রম্নয়ারি রাজধানীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) আইএসও সনদ অর্জন এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবারের মানসম্পর্কিত গবেষণা কাজের ফলাফল প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কাঁচা ও পাস্তুরিত দুধ এবং দইয়ে বিভিন্ন পরিমাণে পেস্টিসাইড, টেট্রাসাইক্লিন, সীসা ও বিভিন্ন অনুজীব পাওয়ার তথ্য প্রকাশের পর এ বাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছে। রাজধানীর যেসব দোকানে আগে প্রতিদিন একশ' থেকে দেড়শ' লিটার প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হতো, সেখানে তা নেমে ৫০ থেকে ৭৫ লিটারে এসে ঠেকেছে। খামারের কাঁচা দুধ বিক্রির পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

এ প্রসঙ্গে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা রাখে। এ জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে ১৯টি মন্ত্রণালয় ও ৫টি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী সেভাবে কাজ না হওয়ায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42545 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1