সেহরি ও ইফতার রোজার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেহরির মাধ্যমে রোজার সূচনা হয় এবং ইফতারের মাধ্যমে সমাপ্তি। তাই ইফতার ও সেহরি সুন্নত পদ্ধতিতে করা আবশ্যক। অথচ মানবিক প্রবৃত্তি, ভুল ধারণা ও স্থানীয় প্রচলনের কারণে সমাজের অনেকেই সেহরি ও ইফতারি গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে ফরজ আদায়ে পিছিয়ে পড়েন। এমনকি অনেকে ফরজ আদায়ও করেন না। যা ইসলামের দৃষ্টিতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এ বিষয়গুলোর প্রতি প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের খেয়াল রাখা জরুরি।
সহিহ মুসলিমে হজরত ইবনে আতিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রাসূল (সা.) সামান্য ইফতার গ্রহণ করে দ্রম্নত নামাজ আদায় করে নিতেন। অথচ অনেক রোজাদার ইফতারিতে অধিক সময় ব্যয় করে মাগরিব ওয়াক্তের শেষ সময়ে নামাজ আদায় করছেন। জামাতে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও শুধু ইফতারিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কারণে তারা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি অনেকে বিনা ওজরে মাগরিব ওয়াক্তের নামাজ ছেড়ে ইফতার গ্রহণে ব্যস্ত থাকছেন। ওয়াক্তের নামাজ আদায় না করে এ ধরনের রোজা রাখা শুধুই 'উপবাস' এবং 'লোক দেখানো' ইবাদত ভিন্ন কিছুই নয় বলে ইসলাম সাফ জানিয়ে দিয়েছে।
এদিকে ইসলাম 'লোক দেখানো' ইবাদত থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় এটাকে বলা হয়- 'রিয়া' বা লৌকিকতা। মহান আলস্নাহর
কাছে লোক দেখানো ইবাদতের কোনো মূল্য নেই। ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া, কোনো কাজ মহান আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। হাদিস শরিফে লোক দেখানো ইবাদতকে শিরক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'আমি তোমাদের ব্যাপারে যে বিষয়ে সর্বাধিক ভয় করছি তা হলো ছোট শিরক।' লোকেরা জিজ্ঞেস করল, 'হে আলস্নাহর রাসুল! ছোট শিরক কী!' জবাবে রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেন, 'ছোট শিরক হলো রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত।' (মুসনাদে আহমদ)।
লোক দেখানো ইবাদত আলস্নাহর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। ইরশাদ হয়েছে, 'নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আলস্নাহর সঙ্গে প্রতারণা করে। আর তিনি তাদের সঙ্গে কৌশল অবলম্বনকারী। যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন আলস্যভরে দাঁড়ায় মানুষকে দেখানোর জন্য। তারা আলস্নাহকে অল্পই স্মরণ করে।' (সূরা : নিসা, আয়াত : ১৪২)।
মহান আলস্নাহ লোক দেখানো ইবাদতকারীকে তার আমলসহ প্রত্যাখ্যান করেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, মহান আলস্নাহ বলেন, 'আমি অংশীবাদিতা (শিরক) থেকে সব অংশীদারের তুলনায় বেশি মুখাপেক্ষীহীন। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সঙ্গে শরিক করে, আমি তাকে ও তার আমলকে বর্জন করি।' (মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৯৮৫)।
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার কাজ দিয়ে পরকালে আলস্নাহর সন্তুষ্টির নিয়ত করে, আলস্নাহ তার অন্তরকে মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেন, তার এলোমেলো কার্যাবলি তিনি সম্পাদন করে দেন এবং পার্থিব সম্পদ তার কাছে লাঞ্ছিত হয়ে আসে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করে, আলস্নাহ দরিদ্রতাকে তার সামনে এনে দেন। তার যাবতীয় কাজকর্ম অগোছালো হয়ে যায়। অথচ সে পার্থিব সম্পদের শুধু ততটুকুই লাভ করে যতটুকু তার জন্য তাকদিরে নির্ধারিত আছে।' (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমদ)।
তবে কেউ আলস্নাহর সন্তুষ্টির আশায় কোনো আমল শুরু করার পর যদি তার মধ্যে লোক দেখানো ভাব জাগ্রত হয় এবং সে তা থেকে সরে আসতে চেষ্টা করে, তাহলে তার ওই আমলও শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি সে তা থেকে সরে না আসে তাহলে তার ওই আমল বাতিল হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আলস্নাহর রাসূল! একবার আমি নামাজ পড়ার সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে আমাকে নামাজ অবস্থায় দেখে ফেলে। এতে আমার মন আনন্দিত হয়। তখন রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেন, হে আবু হুরায়রা! আলস্নাহ তোমার ওপর দয়া করুন, তোমার দ্বিগুণ সওয়াব হয়েছে। প্রথমত, তোমার ইবাদতে গোপনীয়তার কারণে; দ্বিতীয়ত, ইবাদত প্রকাশিত হয়ে পড়ার কারণে।' (তিরমিজি)।
এদিকে লোক দেখানো আমল বা রিয়াকারীর শাস্তি সম্পর্কে কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আলস্নাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তুমি যদি শিরক কর, তাহলে তোমার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা জুমার : ৬৫)।
শিরক দুই প্রকার। বড় শিরক হচ্ছে আলস্নাহ ছাড়া অন্য কাউকে আলস্নাহর সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা এবং ছোট শিরক হচ্ছে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। যা কবিরা গুণাহর চেয়েও ভয়ঙ্কর।
হযরত যুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া সালস্নাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোন আমল করে আলস্নাহ তাআলা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষের সামনে তার দোষ-ত্রম্নটি প্রকাশ করে তাকে অপমান ও অপদস্ত করবেন।) আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে আলস্নাহ তাআলা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন।
রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন- 'কিয়ামাতের দিন যখন আলস্নাহ তায়ালা তার সত্তার কিয়দংশ উন্মোচিত করবেন, তখন ঈমানদার নারী-পুরুষরা সবাই তার সম্মুখে সিজদায় পড়ে যাবে। তবে সিজদা থেকে বিরত থাকবে কেবল ওইসব লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষকে দেখানোর জন্য ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য সিজদা (সালাত আদায়) করত। তারা সিজদা করতে চাইবে বটে; কিন্তু তাদের পিঠ ও কোমর কাঠের তক্তার মতো শক্ত হয়ে যাবে (ফলে সিজদা করতে পারবে না)।' বুখারি, মুসলিম, মিশকাত : ৫৩০৮।