বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ

মশা নিধনে কোনো উন্নতি নেই বেশি ঝুঁকিতে ঢাকা দক্ষিণ

প্রতি একশটি প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায় তাহলে সেটাকে 'ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি' বলা যায়
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি এবং গত দুই বছর চিকুনগুনিয়া নগরবাসীর অনেকের গিঁটে গিঁটে ব্যথা ধরিয়ে দেয়ার পর মশা নিধনে বিপুল কর্মযজ্ঞের হাঁকডাক দেয়া হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে উঠে এসেছে।

মশা নিধনে 'ফগিং মেশিন' হাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলেও তার এলাকায়ই এবার বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও জরিপে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত ৩ থেকে ১২ মার্চ ১০ দিন এই জরিপ চালানো হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি জায়গায় যান জরিপকারীরা। ওইসব এলাকার ৯৯৮টি বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করেন তারা।

বাসার মেঝেতে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, পস্নাস্টিকের ড্রাম, পস্নাস্টিকের বালতি, পানির চৌবাচ্চা ও ফুলের টবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জীবাণু ছড়ানো এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এড়াতে মশা নিধনের কর্মসূচি চালানোর জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা।

মশা নিধন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গত বছরের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, অবনতিও হয়নি। একই রকম আছে। তবে যেহেতু বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে, মশা জন্মের সবচেয়ে ভালো সময় এখন। তাই সিটি করপোরেশনকে মশক নিধনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।'

জরিপে রাজধানীর উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি বেশি ধরা পড়েছে।

প্রতি একশটি প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায় তাহলে সেটাকে 'ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি' বলা যায়। আবার একশ' বাড়ির মধ্যে পাঁচ বা তার বেশি বাড়িতে লার্ভা বা পিউপা পাওয়া গেলে তা 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত হয়।

জরিপে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক বা বিআই (ব্রম্নটাল ইনডেক্স) সবচেয়ে বেশি ৮০ পাওয়া গেছে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে। পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ, নারিন্দা লেন, নারিন্দা রোড, শরৎগুপ্ত রোড, বসু বাজার লেন, মুনির হোসেন লেন, শাহ্‌ সাহেব লেন, মেথরপট্টি, গুরুদাস সরকার লেন, করাতিটোলা লেন, স্বামীবাগ লেন নিয়ে এই ওয়ার্ড গঠিত।

মালিবাগ বাজার রোড, মালিবাগ, বকশীবাগ, গুলবাগ, শান্তিবাগ নিয়ে গড়া দক্ষিণের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৭০।

বিআই ৪০ পাওয়া গেছে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে, ৩০ পাওয়া গেছে ৪ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে। আর বিআই ২০ পাওয়া গেছে ৬, ৭, ১৪, ১৯, ২০, ২১, ২২, ৪৩, ৪৭ এবং ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে।

অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাতটি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।

সর্বোচ্চ ৪০ বিআই পাওয়া গেছে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে; বড় মগবাজার, দিলু রোড, নিউ ইস্কাটন রোড, পশ্চিম মালিবাগ, মধ্য পেয়ারাবাগ ও গ্রিনওয়ে, উত্তর নয়াটোলার কিছু অংশ এই ওয়ার্ডে পড়েছে।

বিআই ৩০ পাওয়া গেছে উত্তরেরর ১, ৪ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। বিআই ২০ পাওয়া গেছে ১৬, ২২ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে।

২০১৮ সালেও এ ধরনের জরিপ চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। তবে এবারের জরিপটি আগের চেয়ে বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল বলে মনে করছেন অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা।

র্'যান্ডম স্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে। আমরা পাকা, সেমিপাকা বাড়ি এবং নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে স্যাম্পল নিয়েছি। এর মধ্যে উত্তরের সাতটা জায়গায় ব্রম্নটো ইনডেক্স হাই (এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাপক)। আর দক্ষিণে ১৫টা জায়গায় এটা বেশি। দক্ষিণের কয়েকটি জায়গায় এটার উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।'

এবার এডিস মশার লার্ভার পাশাপাশি পূর্ণবয়স্ক মশার উপস্থিতিও জরিপ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। এজন্য দুই সিটি করপোরেশনের ১৯টি ওয়ার্ডে ১৪১টি 'বিজি সেন্টিনাল ট্র্যাপ-২' বসানো হয়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮৩টি ট্র্যাপে নয়টি স্ত্রী এবং তিনটি পুরুষ এডিস এজিপ্টি মশা পাওয়া গেছে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৮টি ট্র্যাপে ২৬টি স্ত্রী এবং ৪০টি পুরুষ এডিস এজিপ্টি মশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

বিজি সেন্টিনাল ট্র্যাপ-২ পূর্ণবয়স্ক মশা ধরার আধুনিক পদ্ধতি বলে জানান ম্যালেরিয়া অ্যান্ড এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেজ-এর ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান।

তিনি বলেন, তাদের এ জরিপ শুকনো মৌসুমে হয়েছে বলে মশার উপস্থিতি কম ধরা পড়েছে। শুকনো মৌসুমে এডিস মশা কম থাকাটাই স্বাভাবিক।

'বর্ষায় এটা সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যাবে। কারণ এক ফোঁটা পানি পাওয়ার সাথে সাথে সে ডিম দেয়া শুরু করবে। একটা মশা থেকে তিনশ ডিম পাড়বে। এভাবে বাড়তেই থাকবে। এভাবে বাড়তে থাকলে অবস্থা কি হবে তা চিন্তা করার বিষয়।'

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশার উপস্থিতি বেশি থাকার বিষয়ে তিনি অবগত।

'আমাদের শহরটা পুরাতন শহর, এখানে নর্দমা, বাড়িঘর বেশি। এজন্য মশাও কিছুটা বেশি। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার উপদ্রবটা বাড়ে এটা নিয়ে আমরা কনসার্নড। এজন্য জানুয়ারি মাসেই আমরা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এটা সারা বছর ধরেই চলবে।'

ইতোমধ্যে এই সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অঞ্চলে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে করণীয় নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি শুরু হয়েছে বলে জানান প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

'এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।'

আর উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, বর্ষা মৌসুমে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখতে 'সম্ভাব্য সবকিছু' করছেন তারা।

'যেসব এলাকায় মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে সেসব এলাকায় আমাদের বিশেষ নজর থাকবে। এ ছাড়া ঈদের পর আমরা বিভিন্ন এলাকায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালাব। মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর সচেতনতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছি।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাবে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়েছে।

৩৬টি বেসরকারি হাসপাতালে ১২৩ জন এবং ১০টি সরকারি হাসপাতালে ২৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২৯ এপ্রিল রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত একজনের মৃতু্য হয়েছে।

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় ২০০১ সালে। এরপর মশা নিধনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হলেও প্রতিবছরই ডেঙ্গুতে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

এর মধ্যে ২০১৭ সালে বর্ষায় অনেকেই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত, যে রোগটিও এডিস মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে।

চিকুনগুনিয়া ব্যাপক আকার নিলে মশা নিধনে জোরাল ভূমিকা নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। মেয়র সাঈদ খোকন বেশ কয়েক জায়গায় নিজে উপস্থিত থেকে মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

এরপরেও মশার উপদ্রব থেকে নিস্তার ঘটেনি। সম্প্রতি উচ্চ আদালতও বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছেন।

ওয়াসার পানি পরীক্ষা নিয়ে একটি রিট আবেদনের শুনানিতে দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা হাজির হলে বর্ষা মৌসুমের আগেই মশা নিধনে পদপেক্ষ নিতে তাগাদা দেয় হাইকোর্ট।

শুনানির এক পর্যায়ে তাদের উদ্দেশে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান বলেন, 'শোনেন আরেকটা বিষয়, যদিও রুলের টার্মে এটা নেই, তারপরও বলছি পাবলিক ইন্টারেস্টের বিষয়। এই যে বর্ষার সিজন আসছে, আপনারা যদি এখনই স্টেপ না নেন তাহলে কিন্তু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় মানুষ আক্রান্ত হবে।

'আমরাও কিন্তু ভুক্তভোগী। এই বিষয়গুলো আপনারা ভালোভাবে দেখবেন। আগে থেকেই পদক্ষেপ নেবেন। ২০ তলার উপরেও মশা। এখন থেকেই যদি শুরু না করেন, এই সিজনে আরও বাড়বে কিন্তু।'

তখন ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, 'এগুলো দেখবেন। কারণ, এখানে বিদেশি দূতাবাস আছে। মশার বিষয়টি দেখবেন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50875 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1