শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
বাজেট পর্যালোচনা

বিদেশি শিক্ষক আনার প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

দেশের শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দেশে যোগ্য শিক্ষক তৈরির পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে করে বিদেশ থেকে ভাড়া করে শিক্ষক আনলেও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হবে না
এস এম মামুন হোসেন
  ১৯ জুন ২০১৯, ০০:০০

এবারের বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী শিক্ষার মান বাড়াতে জাপানের অনুকরণে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার প্রস্তাব করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বদলে তারা দেশের শিক্ষা খাতে জেঁকে বসা চরম অব্যবস্থাপনা, শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা, অর্থ লেনদেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া, উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইউজিসিকে অক্ষম করে রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানির বদলে শিক্ষক বিনিময় সংস্কৃতি গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

দেশের শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দেশে যোগ্য শিক্ষক তৈরির পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে করে বিদেশ থেকে ভাড়া করে শিক্ষক আনলেও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হবে না। শিক্ষক আমদানির চেয়ে বরং তারা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া, শিক্ষকদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয় ভেঙে দেয়া, লবিং তদবিরের মাধ্যমে পদ-প্রমোশন বন্ধ করাসহ দেশের ভেতরের সমস্যা সমাধানকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। গত কয়েকটি বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার হিসেবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্তকেও তারা স্বাগত জানিয়েছেন।

তাদের ভাষায়, বিসিএসের বাইরে থেকে নিয়োগ হওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যেখানে শিক্ষার্থীদের মূল ভিত গড়ে ওঠে সেখানকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় বলে বর্ণনা করেছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেকটা স্থানীয়ভাবে এসব নিয়োগ হওয়ার সেখানে শিক্ষক থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগেও লাখ লাখ টাকার বিনিময় হচ্ছে বলে অভিযোগ। এছাড়া দেশের আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসগুলোতে দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে শক্ত ভিত তৈরি করেছে তার শিকড় কেটে ফেলার আহ্বানও জানাচ্ছেন তারা।

কে কোন মতাদর্শের সেটি বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ করা এবং বিসিএসে যোগ্য বলে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও রাজনৈতিক বিবেচনায় গেজেট আটকে দেয়ার মতো বিষয়েরও কঠোর সমালোচনা করছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষায়, এদেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ

\হদেয়ার চেয়ে সে কোন পন্থি এবং শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে কোন প্যানেলকে ভোট দেবে সেটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে; যা একটি জাতির আত্মহত্যার শামিল বলে বর্ণনা করেছেন তারা। এছাড়া তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পিছনে থেকেও শেষের এক বা দুই সেমিস্টারে অলৌকিক শক্তির জোরে সিজিপিএ বেড়ে যাওয়ার সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও কথা বলছেন তারা।

পদোন্নতি এবং বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে কোনো ক্ষমতা প্রদান না করার বিষয় নিয়েও সমালোচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এসব সমালোচনার বাইরে বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানির বদলে শিক্ষক বিনিময়ের জন্য এ দেশের শিক্ষকদের অন্য দেশে গিয়ে ক্লাস নেয়া এবং সেসব দেশ থেকে শিক্ষক এসে ক্লাস করানোর মতো বিনিময় চুক্তির কথা বলছেন শিক্ষাবিদরা। এতে করে একটি শক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে মত তাদের। তা না হলে নিজেদের শিক্ষকরা আধুনিক হওয়ার সুযোগ পাবে না বলেও মত তাদের।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'শিক্ষক আমদানি বিষয়টি ভালো শোনায় না। আর যদি আমদানি করাও হয় তাতে কি পুরো দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব? আমাদের লাখ লাখ শিক্ষক দরকার। কিন্তু আমাদের ভেতরকার অবস্থা এমন যে এখানে সবকিছুতেই রাজনীতির প্রভাব। যোগ্যতার কোনো মূল্যায়ন নেই। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি সর্বক্ষেত্রেই অবস্থা একই। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ফলে বাইরে থেকে শিক্ষক আনার বিষয়টি আমাদের এখানে জাপানের মতো কাজ করবে, এমনটা বলা কষ্টকর। কারণ সেখানে যোগ্যতাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা হয়। আমাদের ব্যবস্থা তার উল্টো। আমাদের এখানে বরং শিক্ষক টাকা দিয়ে হায়ার করার চেয়ে শিক্ষক বিনিময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি হতে পারে। যার আওতায় আমাদের কয়েকশ' শিক্ষক প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে যাবেন। সেখান থেকেও কয়েকশ' শিক্ষক আমাদের দেশে আসবেন। এতে করে একটি সম্মানজনক সম্পর্কও তাদের সঙ্গে আমাদের গড়ে উঠবে। অনেক দেশেই এমনটি আছে। তবে সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকেই সবার আগে বদলাতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির কোনোদিনও উন্নতি হবে না।'

আরেক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটি বিষয় লক্ষ করছি যে শিক্ষক নিয়োগের চেয়ে ভোটার নিয়োগ হচ্ছে কি না, সেটিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিসিএসে যোগ্য বলে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ একজন বিরোধী মতের রাজনীতি করায় তার নিয়োগ আটকে দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আগের ছয়-সাত সেমিস্টারে পিছিয়ে থাকলেও শেষের এক বা দুই সেমিস্টারে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের ফল আলৌকিক ক্ষমতার বলে হু হু করে বেড়ে যায়। একজন শিক্ষার্থীর মূল ভিত গড়ে ওঠে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। শুধু এমপিওভুক্ত। ফলে এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কম। নিয়োগ হয় স্থানীয়ভাবে, যা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত। অর্থ লেনদেন ছাড়া সেখানে একজন পিওনও নিয়োগ হয় না। তাহলে যোগ্যতার মূল্যায়নটি থাকল কই? এটা সবসময়ই একই রকম থেকেছে। এ স্তরে যদি আমরা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে না পারি তবে আমদানি করা শিক্ষক দিয়ে কী হবে?'

এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, 'শিক্ষা অফিসে চরম অব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের পদ-প্রমোশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা, শিক্ষা ভবন ঘিরে দুর্নীতিবাজদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ভালো শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি একটি বিষয় আমাদেরকে অবাক করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়ম তদন্তে গিয়ে কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে এসেছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর নজরে এসেছে কি না, আমি জানি না। তবে এটি ওই কর্মকর্তার নয়, বরং পুরো জাতির জন্য লজ্জার। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের এতটা ক্ষমতা এল কোথা থেকে? রাজনৈতিকভাবে এসব অবৈধ ক্ষমতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা না হলে এই ধৃষ্টতার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনই থাকার কথা নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আদৌ যোগ্য শিক্ষক গড়ে উঠবে? উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে উপাচার্য নিয়োগ হয় সেখানে কতজন উপাচার্যকে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়ে? এটি আজ শুধু আমার না, ছাত্রদেরও প্রশ্ন। শিক্ষকদের অনিয়মে জড়ানোর প্রতিবাদে যখন ছাত্ররা আন্দোলন করে তার পদত্যাগ চায় তখন একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উন্নয়নই আমাদের সবার আগে দরকার। বিদেশি শিক্ষক আমাদের এসব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারবে না। এর সমাধান আমাদের রাজনীতিবিদদেরকেই বের করতে হবে।'

উলেস্নখ্য, এবারের বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়টি বলতে গিয়ে জাপানের সাবেক সম্রাট মেইজির উদাহরণ টেনে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, গুণগত উৎকর্ষ সাধন ও শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। আমাদের দেশেও সম্রাট মেইজিকে অনুসরণ করার সময় এসে গেছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের ছাত্রের অভাব নাই। অভাব হচ্ছে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের। এই সকল বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের জন্য জাপানের সম্রাট মেইজির মতো আমাদেরকেও আজকের প্রয়োজন মেটাতে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসতে হবে।'

ওই বক্তব্যের পরেই বিদেশ থেকে শিক্ষক আনলে কী সুবিধা হবে বা হবে না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। শিক্ষাবিদরা বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বিরোধিতা না করলেও দেশের ভেতরে ভালো মানের শিক্ষক তৈরির জন্য দেশের ভেতরকার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর করতেই সরকারকে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সমালোচকরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<54288 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1