বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন ড্যাপে জনবান্ধব উদ্যোগ, ভাষা বাংলা

ফয়সাল খান
  ২৫ জুন ২০১৯, ০০:০০

সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী করে মাতৃভাষা বাংলায় প্রণয়ন করা হচ্ছে সংশোধিত ডিটেইল এরিয়া পস্ন্যান বা বিশদ নগর অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। শহরকে বাসযোগ্য করতে ভূমির পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনঃবিন্যাস, উন্নতি সাধন ফি, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন, স্কুল জোনসহ জনবান্ধব নানা উদ্যোগ থাকছে এবারের ড্যাপে।

ড্যাপ তৈরির সঙ্গে সংশিষ্টরা বলছেন, আগের ড্যাপের ভুলত্রম্নটিগুলো সংশোধনের পাশাপাশি যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে এ জন্য বিশেষ কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মূল পরিকল্পনার কোনটি কোন এলাকায় বাস্তবায়িত হবে এবং এতে করে ওই এলাকাবাসী কিভাবে লাভবান হবেন, সেটা তারা বাংলাভাষায় প্রণীত মাস্টারপস্ন্যান দেখে সহজে বুঝে নিতে পারবেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকাকে বিশ্বের আধুনিক শহরের মডেলে গড়তে চায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সে লক্ষ্যে সংশোধিত ড্যাপে নতুন কিছু কর্মপন্থা যুক্ত করা হয়েছে। সেসব বাস্তবায়ন হলে রাজউকের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিদ্যমান চেহারা বদলে যাবে। পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিত এলাকা নতুন করে সাজানো হবে।

এ প্রসঙ্গে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'সংশোধিত ড্যাপকে জনবান্ধব করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ মহাপরিকল্পনাটি মাতৃভাষায় প্রণয়ন করা এর মধ্যে অন্যতম কাজ। এ ছাড়া জনগণের মতামত গ্রহণ করে এবারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে।' ড্যাপ বাস্তবায়নেও জনগনের সম্পৃক্ত করার পলিসি (কর্মপন্থা) রাখা হচ্ছে উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন 'সংশোধিত ড্যাপ সিএস, আরএস এবং এমএস রেকর্ডের সমন্বিত অনুসরণ করে করা হচ্ছে। পরিকল্পনায় জনবান্ধব বেশ কিছু বিষয় ড্যাপের মাস্টারপ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।'

রাজউকের পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত বিশদ নগর অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নতুন পাঁচটি কর্মপন্থা অন্তর্ভুক্ত করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনঃবিন্যাস, উন্নতি সাধন ফি, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন পন্থা। রাজউকের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা ২০৩৫ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা শহরের এ মাস্টারপস্ন্যানের গেজেট শিগগিরই প্রকাশিত হবে। সার্বিক কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে।

ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে পুরান ঘিঞ্জি জনপদকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব। সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ কমপন্থা বাস্তবায়ন করে পুরনো শহরগুলোকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করেছে।

ভূমি পুনঃবিন্যাসের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের একত্রিত করে সড়ক, উন্মুক্ত স্থান, পুকুর, ডোবা, খেলার মাঠসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার উপকরণ সৃষ্টি করা। এতে করে তারা সুন্দর ও বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে। বিনিময়ে তাদের সামান্য পরিমাণ জমি ছেড়ে দিতে হবে। এটি সরকারি বা বেসরকারি উভয় উপায়ে হতে পারবে।

উন্নয়ন সাধন ফি : উন্নয়ন সাধন ফি হচ্ছে সরকার আরোপিত এ ধরনের রাজস্ব। এটা ধার্য করা হয় কোনো এলাকায় সরকারি বিপুল বিনিয়োগের ফলে ওই এলাকার মূল্য অনেকগুণ বেড়ে গেলে। এসব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলে সরকার পরবর্তীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। যেমন : কোনো এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো (লেক, রাস্তা, ব্রিজ) নির্মাণের ফলে যে সকল জমির মূল্য পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে সকল জমির ওপর আরোপিত কর। উন্নয়ন সাধন ফি বা করারোপের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে নির্মাণ ব্যয় হয়, তার অংশ বিশেষ উদ্ধার করা হয়ে থাকে।

ট্রানজিট ভিত্তিক উন্নয়ন : এ ধরনের নগর উন্নয়ন মূলত যেখানে গণপরিবহন বা কোন ট্রানজিট স্টেশনকে কেন্দ্র করে করা হয়। গণপরিবহনে জনসাধারণ রাইডার শিক্ষাবৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার হ্রাস করে। এটা হয়ে থাকে, একটি ট্রানজিট স্টেশন বা স্টেপকে কেন্দ্র করে উচ্চ ঘনত্বের মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়। এটা করা হয়ে থাকে, অন্তর্ভুক্তিমূলক আবাসনের সংস্থান, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার হ্রাস, যানজট ও দূষণ হ্রাস করা, মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করা, কমিউনিটির ভিতর পরিকল্পনা ও যোগাযোগ ব্যবহার সংস্থান করা, কম্প্যাক্ট শহর উন্নয়ন, বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব নগর উন্নয়ন ও মানুষের ঘন যাতায়াত হ্রাস করা।

উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন (টিডিআর): এর মাধ্যমে একজন তার উন্নয়ন স্বত্ব অন্য আর একজনকে দিয়ে দিবেন। বিনিময়ে আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এটি প্রচলিত ভূমি ব্যবহার দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণের এটি উদ্ভাবনী কৌশল মাত্র। ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় কিছু এলাকা থাকে- যেমন : উন্মুক্ত স্থান, কৃষি জমি, বন্যা প্রবাহ এলাকা, পরিবেশগত সংবেদনশীল এলাকা, অথবা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে সাধারণভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়া অনুমোদিত নয় বা সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত থাকে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যায়যায়দিনকে বলেন, রাজউক সংশোধিত ড্যাপে ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনঃবিন্যাস, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়নসহ বেশ কিছু নতুন কর্মপন্থা সুপারিশ করছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এসব কর্মপন্থা অবলম্বন করে উন্নতি লাভ করেছে। অনেক পরে হলেও আমাদের দেশে এসব বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকা শহরের অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটবে। পরিকল্পনা সুন্দর থাকলেও বাস্তবায়ন সঠিক না হলে এর সুফল পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন তিনি।   

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউকের সংশোধিত ড্যাপে ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনঃবিন্যাসসহ বেশ কিছু নতুন কর্মপন্থা ভালো। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের অনেক দেশ এসব কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করে ঘিঞ্জি জনপদ থেকে আধুনিক শহর গড়ে তুলেছে। এসব কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করে ঢাকাকেও বিদ্যমান অবস্থা থেকে উন্নত করা সম্ভব হবে।

কর্মকর্তাদের মতে, বিদ্যমান বিতর্কিত ড্যাপের দুর্নাম ঘোচাতে এবার অন্যান্য ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন আসছে। সংশোধিত ড্যাপ সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর পর মেট্রোপলিটন এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং পেশাজীবীদের সঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বড় পরিসরে এবং বিষয়কভিত্তিক সমন্বয় সভার আয়োজন করা হবে। ওই সভায় রাজউকের পরিকল্পনা উইং থেকে ড্যাপের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মূল বিষয়বস্তু ও করণীয় উপস্থাপন করা হবে। সেসব প্রস্তাবনায় ভূমি ব্যবহার, উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, যানবাহন, ড্রেনেজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি প্রভৃতি স্থান পাবে। আর ড্যাপের পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা অথবা বাস্তবায়নকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থার চিন্তাভাবনা বোঝার জন্য প্রতি ছয় মাস অন্তর ড্যাপ রিভিউ সভা আহ্বান করা হবে। এসব সভায় ড্যাপের নির্দেশিত নীতিমালা, সুপারিশসমূহের পরিমার্জন বা পরিবর্ধন লাগবে কিনা, সে ব্যাপারে যৌক্তিক দিকনির্দেশা দেয়া হবে। যেটা ড্যাপের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এ মাস্টারপস্ন্যান প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হালনাগাদ করা হবে। ড্যাপভীতি দূর করতে ড্যাপের গেজেট ও ম্যাপ রাজউকের আওতাধীন এলাকার সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বরাবর প্রেরণ করা হবে। এ ছাড়া এ ব্যাপারে ড্যাপের পরিকল্পনা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যাপকভাবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হবে। রাজউকের ড্যাপের এবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শহরবাসীর সাঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নে যেমন, রাজউকের আওতাভুক্ত সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং পেশাজীবী সংস্থার মতামত বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল, তেমনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়ও এলাকাবাসীর মতামত আমলে নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, রাজউকের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা শহরের এ মাস্টারপস্ন্যানটি চলতি মাসেই গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সার্বিক কার্যক্রমে এটি চলতি বছরের শেষে দিকে গেজেট আকারে প্রকাশ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রথম ড্যাপ মাস্টারপস্ন্যান প্রণয়ন করা হয় ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে প্রথম ড্যাপের মেয়াদকাল শেষ হয়েছে। বর্তমানে ওই ড্যাপের সময় বৃদ্ধি করে নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে রাজউক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55237 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1