শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পিছিয়ে পড়া ১৮ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি বন্ধ

নূর মোহাম্মদ
  ২৭ জুন ২০১৯, ০০:০০

অর্থ সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া প্রায় ১৮ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে গেছে। দেড় বছর আগে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে দুর্গম অঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি বন্ধ রয়েছে। আকস্মিক উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুবিধাভোগী ওইসব শিক্ষার্থীর চলমান শিক্ষাজীবনে ছন্দপতন ঘটেছে।

এদিকে গত নভেম্বরে চালু হওয়া ৫ বছর মেয়াদি নতুন প্রকল্প সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট (এসইডিপি) আওতায় এসব শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করতে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে 'সেকায়েপ' (সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট) প্রকল্পটি চালু করা হয়। ওই সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৪শ' ৮০ কোটি টাকা। ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশের দুর্গম ১২৫টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের সাফল্যের প্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যাংকের অতিরিক্ত অর্থায়নে আরও ৯০টি উপজেলা প্রকল্পভুক্ত করে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করে প্রকল্প। পরবর্তীতে আরও ৩৫ উপজেলায় প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে মোট ২৫০টি উপজেলা প্রকল্পভুক্ত করা হয়। এসব উপজেলার পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ১৮ লাখ শিক্ষার্থীকে মাসিক উপবৃত্তি দেওয়া হতো। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে উপবৃত্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে সারা দেশের মাধ্যমিক স্তরের (স্কুল-মাদ্রাসা) ১৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উপবৃত্তি পাচ্ছেন না। অর্থ সংকটের ফলে দরিদ্র এসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া চালিয়ে নিতে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সেকায়েপ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট ছিল- প্রক্সি মিন্স টেস্টিং (পিএমটি)-এর মাধ্যমে অতি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও টিউশন ফি কার্যক্রম। এই কম্পোনেন্টের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অধিকহারে বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ ও এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তাদেরকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখা, পিএমটিভিত্তিক উপবৃত্তি ও টিউশন ফি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি ও ঝরে পড়ার হার হ্রাস করা। পিএমটি হলো একটি পরিবারভিত্তিক প্রো-পুওর টার্গেটিং পদ্ধতি যা আবেদনকারীকে কিছু নির্ধারিত চলকের (ঠধৎরধনষব) ভিত্তিতে বাছাই করে সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী মাসিক ১৫০ টাকা, ৭ম শ্রেণিতে ১২৫ টাকা, ৮ম শ্রেণিতে ১৯০ টাকা ও দশম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেয়া হতো। সারা দেশের ২৫০ উপজেলার ১৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এই উপবৃত্তির সুবিধা পেত। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে দেড় বছর ধরে উপবৃত্তির অর্থ বঞ্চিত হচ্ছেন এসব শিক্ষার্থী। তবে বরিশাল বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ২০১৬ সালের জুন থেকে উপবৃত্তি পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।

একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, যে কোনো সফল প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট চালু রাখতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবগত করতে হয়। কিন্তু প্রকল্পের পিডি বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে বেশি সময় ব্যস্ত থাকায় তিনি এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। বরং প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তদ্বির করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিয়েছেন। মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালকও উপবৃত্তি চালু রাখতে কোনো ভূমিকা নেননি। এই দুই কর্মকর্তার উদাসীনতার কারণে শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষা ও প্রাথমিক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এ তিন স্তরে মোট ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার। মানব সম্পদ উন্নয়নে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সফল কর্মসূচির অন্যতম হলো উপবৃত্তি। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী যারা দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামী ইত্যাদি কারণে শিক্ষালাভ হতে বঞ্চিত ছিল। এসব জনগোষ্ঠীকে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রথম বেসরকারিভাবে ১৯৮২ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রকল্প চালু হয়। বর্তমানে শিক্ষা ও প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ৬টি প্রকল্প চালু রয়েছে। তার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে পিইডিপি-৪ (চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প)-এর মাধ্যমে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট (এসইএসপি)/ মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি ২য় পর্যায়ে ২১৮টি উপজেলায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত (স্কুল ও মাদ্রাসা) শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় উপবৃত্তি দেয়া হয়। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধসহ ছাত্রী ড্রপআউট এবং শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকার এ উপবৃত্তি চালু করে। স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট-এর অর্থায়নে সারা দেশে এই প্রকল্পটি পরিচালিত চলছে। এছাড়াও মাধ্যমিক স্তরে এসইএসপি (মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প), সেসিপ (সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম)-এর মাধ্যমে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির সুফলভোগীর তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে সেকায়েপ প্রকল্পের ১৮ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত।

সরকার গত নভেম্বর মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সকল প্রকল্প একীভূত করে সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট (এসইডিপি) প্রকল্প চালু করেছে। পাঁচ বছর মেয়াদে এই প্রকল্পে ১৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সরকার, বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগিতায় এই প্রকল্পের অর্থ যোগান হবে। আট মাস আগে এসইডিপি চালু হলেও সেকায়েপ প্রকল্পের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পায়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সাম্য রক্ষার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপবৃত্তি চালু করে সরকার। তবে কিছু কর্মকর্তার খামখেয়ালীতে ভেস্তে যেতে বসেছে এ প্রকল্প।

এ ব্যাপারে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার রাজাপুর মডেল পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমার স্কুলের ১১৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৬৪ জন উপবৃত্তি পেত। দেড় বছর ধরে উপবৃত্তি বন্ধ রয়েছে। উপবৃত্তি বন্ধ হওয়ায় এখন তাদের বেতন দিতে হয়। আর্থিকভাবে অসচ্ছল অনেক অভিভাবক অর্থের অভাবে সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা তাদের বাড়ি গিয়ে বিনা বেতনে পড়াশোনার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে এনেছি। উপবৃত্তি চালু না করলে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। যারা এসএসসি পাস করে চলে গিয়েছে তারা উপবৃত্তির জন্য যোগাযোগ করলেও কোনো জবাব দিতে পারি না। উপকূলীয় পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অবনী কুমার রায় বলেন, আমার স্কুলটি নদী ভাঙনকবলিত এলাকায় অবস্থিত। অধিকাংশ শিক্ষার্থী জেলে পরিবারের। ২৬৬ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেত। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উপবৃত্তি বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়ে পরিবারের আয় বাড়াতে কাজে যোগ দিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55530 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1