শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এরশাদহীন জাতীয় পার্টি কোন পথে

নতুনধারা
  ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক

শেষ কয়েকটা বছর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার দলের কর্মীদের মধ্যে আশা জাগানোর চেষ্টায় বলতেন, 'শৃঙ্খলমুক্ত' হয়ে আবারও জেগে উঠবে জাতীয় পার্টি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছিলেন, 'মৃতু্যর আগে আমি জাতীয় পার্টিকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাই। আমি দেখে যেতে চাই জাতীয় পার্টি জনগণের দল হয়েছে, তারা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।'

তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। অবশ্য জাতীয় পার্টিকে 'জনগণের দল' হিসেবে গড়ে তোলার বা তার ভাষায় 'শৃঙ্খলমুক্ত' হওয়ার তেমন কোনো চেষ্টাও বিগত বছরগুলোতে দেখ যায়নি। রাজনীতির দাবার ছকে টিকে থাকার জন্য এরশাদ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্য রেখে গেছেন; পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব, আর মারা গেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে।

সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এরশাদ অন্য অনেক সেনাশাসকের মতোই রাজনৈতিক দল গড়ে নিজের ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক মোড়ক দেয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদের দল জাতীয় পার্টির জন্ম হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় পার্টি পরিচালিত হয়ে আসছিল এরশাদের একক কর্তৃত্বে। নেতাদের পদোন্নতি বা পদচু্যতিসহ নীতিনির্ধারণী সবকিছুই তার মর্জি অনুযায়ী চলত। জাতীয় পার্টিকে এরশাদ সবসময় 'আমার দল' হিসেবেই উলেস্নখ করতেন।

মৃতু্যর আগে এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে গেছেন, তবে এ নিয়েও কম নাটক করেননি। অসুস্থ অবস্থায় ভাইকে দলের ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কিছুদিন পর আবার তাকে 'ব্যর্থতার' অভিযোগে পদচু্যত করেছিলেন এরশাদ। কিছুদিন পর রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে আবার ভাইকে নেতৃত্বে ফেরান তিনি।

দলের নেতৃত্ব নিয়ে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক চলছে জি এম কাদেরের। তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পর থেকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন দলের কর্মসূচিতে আসছেন না।

সংসদে প্রধান বিরোধী দলের তকমা থাকলেও জাতীয় পার্টি এখনও রয়ে গেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে। এ নিয়ে দলেই নানা সমালোচনার মুখে দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা ক'দিন আগে মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।

সব মিলিয়ে এরশাদের মৃতু্যর পর এখন জাতীয় পার্টির হাল কে ধরবেন, কীভাবে এ দল পরিচালিত হবে- সেসব প্রশ্ন ঘুরছে অনেকের মনে।

সময়ই সব বলবে: মুশতাক হোসেন

ডাকসুর সাবেক জিএস ও বাংলাদেশের জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, এরশাদহীন জাতীয় পার্টি টিকবে কি না- সে বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি।

তিনি বলেন, 'এর জন্য ওয়েট করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ধারা রয়েছে। সে ধারাগুলো নিয়ে কী করবে তারা- এখনও বলা যাচ্ছে না।'

এ বিষয়ে বলতে গিয়ে এরশাদের পূর্বসূরি আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও বিএনপির প্রসঙ্গ টানেন মুশতাক।

তিনি বলেন, 'সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানও দল করেছিলেন। সেটাও রয়েছে। এখন দেখা যাক, জাতীয় পার্টি কোন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যক্তি এরশাদও তো আছেই, এছাড়া একটা জনগোষ্ঠী, জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে কারও না কারও স্বার্থ রক্ষা করেছে। তারা রাজনীতিতে কী ভূমিকা পালন করে, সেটা ভবিষ্যতে দেখার বিষয় রয়েছে। এ মুহূর্তে বলে দেয়া যাবে না।'

বাংলাদেশের জাসদের এই নেতা বলেন, সামরিক শাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী' সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ধারা তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে যে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ধারা ছিল; সেটা এখন অনেকখানি পিছিয়ে গেছে।

'আমরা কিন্তু আন্দোলন করে শুধু সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাটি আনতে পেরেছি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসেছে। কিন্তু বিশেষ করে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমীকরণের যে পরিবর্তন জিয়াউর রহমান ও এরশাদ করেছে, সেটার প্রভাব এখন দেখতে পাচ্ছি আমরা।'

মুশতাকের ভাষায়, জাতীয় পার্টি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নাকি টিকে যাবে- এটা এখনই বলা যাবে না, কারণ তাদের যে 'দেশি-বিদেশি লবি, শক্তি, গ্রম্নপগুলো' রয়েছে, ক্ষমতা বলয়ের বিভিন্ন অংশ রয়েছে, তাদের ভূমিকা কেমন হবে তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

'আমরা একটা সামান্য অংশকে পরাস্ত করতে পেরেছি। পোশাকি গণতন্ত্র যাকে বলে আমরা আনতে পেরেছি। এটার গুরুত্বও কম না। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে ধারা পাকিস্তানের সময় পরাজিত হয়েছিল, একাত্তরে। ওই ধারাকে মোকাবেলা করতে না পারলে এদেরকে এক ঘষাতেই মুছে ফেলা মুশকিল হবে।'

জাপা আর ঐক্যবদ্ধ দল

থাকবে না: কামাল লোহানী

জাতীয় পার্টির যে ইতিহাস, তাতে এরশাদের মৃতু্যর সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান দলেরও মৃতু্যঘণ্টা বেজে গেল বলে মনে করছেন নব্বইয়ের দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থাকা সাংবাদিক সাংস্কৃতিক কর্মী কামাল লোহানী।

তিনি বলেন, 'স্বৈরশাসক মারা গেছে আমরা রেহাই পেয়েছি। এ রকম একটা বিতর্কিত, সমালোচিত রাজনীতি করা লোক উনি (এরশাদ); দেশ জাতি রক্ষা পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দলেরও অবসান ঘটতে পারে। দলের যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, সে দল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।'

কামাল লোহানীর দৃষ্টিতে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের 'খুবই বুদ্ধিমান ও ব্রিলিয়ান্ট' মানুষ। তিনি হয়তো দলকে এক রাখার চেষ্টা করে যাবেন।

'কিন্তু পারবে বলে মনে হয় না। আমি এটাকে রাজনৈতিক দল বলে গণ্যই করতে চাই না। এটা ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক, মানুষের প্রতি এদের কোনো কমিটমেন্ট রয়েছে বলে মনে হয় না।'

এরশাদের শাসনামলের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'স্বৈরশাসনের ৯ বছর, তাদের ক্ষমতা তো দেখেছি। সময় মানুষকে কীভাবে হত্যা করেছে, কীভাবে দুর্নীতি করেছে। তার (এরশাদ) সম্পর্কে তো কিছু বলা যাবেই না। দলের লোকজন যারা এত বছর ধরে সহ্য করেছে তারা কতটা সৎভাবে রাজনীতি করতে পারবে- এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে।'

এ অবস্থায় হাল ধরে জাতীয় পার্টিকে জনগণের দল হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে নিতে পারেন- এমন কাউকে দেখছেন না কামাল লোহানী।

'জি এম কাদের অল্প কিছুদিন হয়েছে রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদও নন। আর যারা আছেন তারা ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন, কিন্তু এই ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে নিজেদের ডুবিয়েছেন।'

'ক্ষমতার জন্যই এ দলটা তৈরি হয়েছিল সামরিক শাসনের প্রবর্তনের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে স্বৈরশাসন দিয়ে ক্ষমতার কালটা শেষ করেছে। বিতর্কিত, সমালোচিত একটা মানুষ চলে গেছে, উত্তরাধিকার হিসেবে দল থাকবে, হয়তো সেটা ক্ষুদ্রাকারে থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না ঐক্যবদ্ধ একটা দল থাকবে।'

জাপার ভবিষ্যৎ আ.লীগের

হাতে: মুনতাসীর মামুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং তারপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের চেতনার মৌলিকত্বগুলো 'একেবারে ধ্বংস করে' দিয়ে গেছেন।

'রাষ্ট্রধর্ম করে তিনি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একেবারে নাকচ করে দিলেন। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তিনি সংবিধানকে নষ্ট করেছেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করে বসা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একসময় আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন।'

নব্বইয়ের দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদকে তাদের জোটে ভেড়ায়।

এ নিয়ে আওয়ামী লীগকে বিস্তর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে মন্তব্য করে মুনতাসীর মামুন বলেন, 'গত কয়েক বছরে এরশাদ তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। এছাড়া রাজনীতিতেও নানা কারণে সমঝোতা হতে পারে। আওয়ামী লীগের মনে হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে এরশাদ তাদের ভালো মিত্র হবেন।'

তার ভাষায়, 'আগামীতে এরশাদের জাতীয় পার্টির টিকে থাকার সবটুকু নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের কৃপার ওপরে।'

এরশাদহীন জাপার ভবিষ্যৎ

দেখি না: জেপির শহীদুল

এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে আলাদা হয়ে দুই দশক আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে গড়া জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম একসময় এরশাদের জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।

তার ভাষায়, জাতীয় পার্টির রাজনীতি ছিল এরশাদকে ঘিরেই, তার কারণেই দলটি এতদিন টিকে ছিল।

'এরশাদের জাতীয় পার্টির দুর্বলতা হলো- এটা অন্য দলনির্ভর দল। কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও অন্য দলের; বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অনুগ্রহেই সংসদে কিছু আসন পেয়েছে।

এরশাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল, কিন্তু দলের ব্যাপক জনসমর্থন নেই। এরশাদবিহীন এ দলের ভবিষ্যৎ তেমন দেখি না।'

এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে আলাদা হওয়া চারটি অংশ এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। জেপি ছাড়া বাকি দলগুলো হলো বিজেপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি এবং জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)।

শেখ শহীদুল ইসলামের মতে, এরশাদের জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে দুটি বিষয়ের ওপর।

'একটি হলো- সব অংশকে একত্রিত করা। জাপার সবাইকে একত্রিত করে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা। দ্বিতীয়টি হলো- দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা করে সঠিকভাবে নেতৃত্ব ঠিক করা। ঐক্যবদ্ধ হলে জাপার ভবিষ্যৎ থাকবে। তা না হলে ভবিষ্যৎও নেই।'

জাপা নেতারা কী ভাবছেন?

এরশাদের জানাজা-দাফন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতাই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, 'এটা কখনোই মনে হয় না যে দল ফের বিচ্ছিন্ন হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আদর্শে দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের দুজন একই সূত্রে গাঁথা। তারাই দলকে নেতৃত্ব দেবেন, দলকে একতাবদ্ধ রাখবেন।'

আর দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, 'দলে যারা বিশৃঙ্খলা করতে চায়, তারা সুবিধা করতে পারবেন না। জি এম কাদের দলকে একতাবদ্ধ রাখবেন। দল ভাঙার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58600 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1