বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় ভরা বর্ষায় খোঁড়াখুঁড়ির মহাযজ্ঞ

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
বর্ষা মৌসুম শুরুর পর শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই নয়, ওয়াসা-ডেসকোসহ অন্য সেবা সংস্থাগুলোও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির পালস্নায় জোর কদমে এগিয়ে চলছে। যা ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়ে জনভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। ছবিটি বুধবার মিন্টো রোড থেকে তোলা -আমিনুল ইসলাম শাহিন

বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাস কোনো সড়ক মেরামত করা যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে রাস্তা খনন করতে হলে খননকারী কর্তৃপক্ষকে মূল ক্ষতিপূরণসহ অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ফি গুনতে হবে। রাস্তা খননের পর সেখানে সৃষ্ট গর্ত বালি দিয়ে ভরাট, ব্রিক-সলিং ও হেরিংবন্ড করে দ্রম্নত যান চলাচলের উপযোগী করতে হবে। যে এলাকায় সড়ক খনন করা হবে সেখানে কমপক্ষে সাত দিন আগেই মাইকিং করাসহ নানাবিধ প্রচার চালাতে হবে। এসব বিধান স্টেক হোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে অতি সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগ 'ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯' খসড়া চূড়ান্ত করলেও খোদ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনই তা মানছে না। বরং নানা দোহাই দিয়ে ভরা বর্ষায় নগরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও রাস্তা খোঁড়ার পর প্রয়োজনীয় কাজ দ্রম্নত শেষ না করে তা দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা হচ্ছে। যা বৃষ্টির পানিতে ডুবে রীতিমতো 'মৃতু্যফাঁদ' হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে নগরবাসী উদ্বেগ-আতঙ্কে দিন কাটালেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বরাবরের মতো নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনেই তাদের এ ভরা বর্ষায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে এসব কাজ দ্রম্নত শেষ করার জন্য তারা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের চাপে রেখেছে। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নেয়া ড্রেনেজ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ সময়মতো ছাড় না হওয়ায় এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলেও স্বীকার করে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি।

তবে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে কর্তৃপক্ষের এ দাবির সঙ্গে বাস্তবতার ততটা মিল পাওয়া যায়নি। বরং এর নেপথ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের গাফিলতি ও দুর্নীতির নানা চিত্র উঠেছে এসেছে।

এদিকে গতিহীন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও নাখোশ হয়েছেন। বছরের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এ সম্পর্কিত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়, অর্থের অভাবের পাশাপাশি বিলম্বে প্রকল্প অনুমোদনও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। ঠিকাদারদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রত্যেক মাসে সিটি করপোরেশনের যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা তা ঘুষবাণিজ্যের

মাধ্যমে ম্যানেজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মুগদা, বাসাবো, আর কে মিশন রোড, খিলগাঁও, গুলবাগ ও মিরপুর এলাকায় রাস্তা খুঁড়ে সু্যয়ারেজ ও পানি নিষ্কাষণ লাইনের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। এছাড়া নগরীর বেশকিছু রাস্তার পাশে বিশাল আকৃতির শত শত পাইপ এনে রাস্তার দুই পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ওইসব সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছে, তারা কেউই 'ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯' মানছে না।

মালিবাগ কাঁচাবাজারের বিপরীতের রেলগেট থেকে আবুজর গিফারী কলেজ হয়ে গুলবাগ পর্যন্ত রাস্তা কেটে মাস দেড়েক আগে পাইপ বসানো হলেও রাস্তার বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় গর্ত থাকায় তা এখনো যানবাহন চলাচলের অনুপোযোগী। সামান্য বৃষ্টি হলেই এ রাস্তা কাদা-পানিতে একাকার হয়ে পড়ছে। এ সময় ওই রাস্তায় পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেও কষ্ট হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের অধিকাংশ প্রধান সড়কের দুই পাশে গত এক সপ্তাহ ধরে শত শত পাইপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ বাকী সড়কের পসরার গলি হিসেবে পরিচিত রাস্তার মুখে দুটি পিট এবং এ-সংলগ্ন প্রায় দুই শ ফিট সড়ক কেটে পাইপ বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ওই সড়কের আরও কিছু অংশ ভেকু দিয়ে খুঁড়ে রাখা। কোথাও আবার রাস্তা খুঁড়ে পুরান ভাঙা পাইপ তুলে তা রাস্তার ওপর ফেলে রাখা হয়েছে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা রাস্তার পিচ-পাথরের স্তূপ। ফলে ওইসব সড়কে যান চলাচল বেশকিছু দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অন্য রাস্তার দুই পাশে বিশাল আকৃতির পাইপ সাজিয়ে রাখায় সেখানে নিত্যদিন যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে অতি বৃষ্টির পানি জমে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় এ লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নেয়া একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে গোড়ান-তিলপাপাড়া এলাকায়। সেখানেও বেশকিছু রাস্তা কেটে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়েছে। তবে নিয়মানুযায়ী পাইপের পাশে বালু ভরাট করার কথা থাকলেও বেশকিছু জায়গায় মাটি দেয়ায় তা বৃষ্টির পানিতে গলে কাদায় রূপ নিয়েছে। এছাড়া সেখানকার বেশকিছু রাস্তা খুঁড়ে রাখা হলেও এখনো সেখানে পাইপ বসানো হয়নি। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ওইসব গর্ত পুরোটাই পানিতে ডুবে গেছে। ফলে এসব রাস্তায় যান চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে গেছে।

গোড়ানের বাসিন্দা আব্দুল মালেক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'বর্ষায় যখন রাস্তা তলিয়ে যায়, তখন আর বোঝার উপায় থাকে না কোথায় গর্ত আর কোথা রাস্তা কেটে খাল করে রাখা হয়েছে। কেন যে শুধু বর্ষাতে রাস্তা কাটা হয় তা আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে বছরের পর বছর শুধু এ সময়ই "উন্নয়নের মহাযজ্ঞ" চলবে।'

এদিকে বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের অদূরবর্তী সালাম ডেইরি ফার্মের বিপরীত গলি থেকে আহম্মদবাগ কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেও সু্যয়ারেজ লাইনের বিশাল আকৃতির শত শত পাইপ এনে জড়ো করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই সেখানে রাস্তা কেটে পাইপ বসানোর কাজ শুরু হবে বলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিশ্চিত করেছেন।

সামান্য বৃষ্টি হলেই এ রাস্তায় এমনিতেই হাঁটুপানি জমে। এর ওপর ভরা বর্ষার মৌসুমে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ নেবে- এ আশঙ্কায় ভাড়াটিয়াদের অনেকেই এখনই বাসা ছাড়তে শুরু করেছেন। বাড়ির মালিকরাও অনেকে বর্ষা মৌসুমের জন্য অন্য এলাকায় বাসা খুঁজছেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে নগরীর মতিঝিল-সংলগ্ন রামকৃষ্ণ মিশন এলাকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। জুনের মাঝামাঝি থেকে সেখানকার বেশ কয়েকটি সড়কে সু্যয়ারেজ লাইনে নতুন পাইপ বাসানোর কাজ শুরু হয়েছে। তবে রাস্তা খুঁড়ে পাইপ বসানোর পর এর চারপাশের গর্তে বালি ভরাট করে উপরিভাগে ম্যাকাডাম (বড় আকারের খোয়া) বিছিয়ে রাস্তা সমান করার কাজ চলছে অনেকটা ঢিলে তালে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

রামকৃষ্ণ মিশন এলাকার বাড়ির মালিক এনামুল হক জানান, ভরা বর্ষায় রাস্তা খুঁড়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। এতে সৃষ্ট বড় বড় গর্ত মৃতু্যফাঁদ হয়ে উঠছে। টানা বৃষ্টিতে গোটা রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চালক ও পথচারীরা ডুবে থাকা গর্ত আনুমান করতে পারছে না। এতে প্রায়ই ছোট-বড় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে।

এনামুল হক আরও জানান, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে স্থানীয়রা নিত্যদিন চরম দুর্ভোগ পোহালেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করায় সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। যে কোনো মুহূর্তে সেখানে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে বর্ষা মৌসুম শুরুর পর শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই নয়, ওয়াসা-ডেসকোসহ অন্য সেবা সংস্থাগুলোও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির পালস্নায় জোর কদমে এগিয়ে চলছে। বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া ও কাফরুলসহ নগরীর অন্তত ৪০টি সড়কে এসব সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে রাস্তা খুঁড়ে উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যা ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়ে জনভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, সড়ক খনন নীতিমালা অনুযায়ী নিষিদ্ধ সময়েও জরুরি কাজে সড়ক কাটার কথা বলা আছে। সেক্ষেত্রে দেড় গুণ ফি পরিশোধ করতে হয়। এই সময়ে জরুরি কাজ ছাড়া কাউকে সড়ক কাটার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন, যে কয়েক জায়গায় সড়ক কেটে উন্নয়ন বা সংস্কার কাজ করা হচ্ছে এগুলোর বেশির ভাগই ইমারজেন্সি কাজ। তাছাড়া আগে থেকে চলমান কিছু প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58725 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1