শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
দুধে বিপদজ্জনক উপাদান

উদ্বেগে ভোক্তা, নিরুদ্বেগে সরকার

সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

সরকারি-বেসরকারি একাধিক গবেষণায় বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত গরুর দুধে বিপজ্জনক অণুজীব, এন্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও সিসার উপস্থিতি ধরা পড়ায় উদ্বিগ্ন ভোক্তাদের অনেকে বাজারে বিক্রি প্যাকেটজাত দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি স্থানীয় খামারির গোয়ালে পোষা গরুর দুধ কিনতেও তারা ভয় পাচ্ছেন। এতে শিশু-কিশোরসহ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্যালসিয়াম ঘাটতিতে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), প্রাণিসম্পদ ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ নিয়ে এখনো অনেকটা নিরুদ্বেগে সময় পার করছে। বরং কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ দুধে বিপজ্জনক উপাদান থাকার বিষয়টি গোপন করতেই বেশি সচেষ্টা রয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

তাদের ভাষ্য, দুধে এন্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও সিসাসহ যেসব উপাদান পাওয়া গেছে সেটি মাত্রাতিরিক্ত কি না এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়টি তারা আগে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে চাইছে। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত গবেষণার ফল সরাসরি মিডিয়ায় প্রকাশের কারণে জনমনে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা দূর করতে সচেষ্ট রয়েছে। তবে সত্যিকার অর্থে দুধে বিপজ্জনক কোনো উপাদান থাকলে সে সমস্যা কীভাবে কাটানো যায় এ ব্যাপারেও দ্রম্নত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

যদিও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, বিএসটিআই, প্রাণিসম্পদ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে প্রাণিসম্পদ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শিগগিরই তারা জরুরি বৈঠকে বসে এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করবে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রাণী বিভাগ) এ কে এম মনিরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিএসটিআইর গবেষণাগুলো আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমরাও উদ্বিগ্ন। সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব দেশের বাইরে রয়েছে। তারা দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি ব্যাখ্যা দেয়া হবে।'

একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল অপর এক কর্মকর্তা বলেন, 'দুধে ব্যাকটেরিয়াসহ গবেষণা যা এসেছে তা আমাদের আগে জানানো হলে বিষয়টি ক্রস গবেষণা বা পরীক্ষা করার সুযোগ থাকত। যেহেতু সেই সুযোগটুকু তৈরি হয়নি, তাই আমরা বিকল্প গবেষকদের দিয়ে আরেকটি গবেষণা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণাটি আরেকটু ক্রস চেক করানো হবে। তারপর ব্যাকটেরিয়াসহ অন্য যেসব উপদান দুধে পাওয়া গেছে সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।'

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের গবেষণায় বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ধরা পড়লেও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন বিএসটিআই তাদের পরীক্ষার ফল ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে পরোক্ষভাবে এ বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা জানিয়েছে, পাস্তুরিত দুধে কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই। যদিও পরে তাদের এ অপকৌশল পুরোটাই ভেস্তে গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসহাল আলী বলেন, 'আদালত আমাদের পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী আমরা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। সুতরাং যা জবাব দেয়ার তা আদালতেই দেয়া হবে।' তবে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (মান) সাজ্জাদুল বারি স্বীকার করেন, বিএসটিআইর নীতিমালায় এন্টিবায়োটিক পরীক্ষার কথা উলেস্নখ নেই। এমনকি এ ধরনের পরীক্ষার যন্ত্রপাতিও নেই।

অন্যদিকে দুধের ক্ষতিকর উপাদান নিয়ে সাধারণ ভোক্তার রাতের ঘুম হারাম হলেও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখনো এ ব্যাপারে তাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারেনি। বরং এ নিয়ে তারা এখনো গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক মাহফুজুল হক বলেন, 'কোন পদ্ধতিতে পণ্যগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলো আগে দেখতে হবে। সব সিস্টেমে একই রেজাল্ট আসবে ব্যাপারটা তা নয়। আবার একই পণ্যের আলাদা স্যাম্পল সবসময় একই ধরনের ফলাফল দেয় না। তবে, যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। গবেষণা শেষে হয়তো বলতে পারব।'

এন্টিবায়োটিক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর, তাহলে এই পরীক্ষা না করে পাস্তুরিত দুধকে নিরাপদ বলা কতটা যুক্তিসংগত? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বিএসটিআই ভালো বলতে পারবে। তবে প্রয়োজন মনে হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেকোনো পরীক্ষা করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব উপাদান দুধে উপস্থিতির কথা ঢাবির গবেষকরা বলেছেন সেগুলো মানবদেহের জন্য চরম হুমকি। কেননা রোগের উপস্থিতি ছাড়া শরীরে যে কোনো এন্টিবায়োটিক প্রবেশ করলে তা তার সঠিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। ফলে এগুলো খুব শক্তিশালী আকার ধারণ করে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট রোগের আক্রমণ হলে ওই এন্টিবায়োটিক খেলেও রোগ নিরাময়ে আর কাজ করে না। এ অবস্থায় রোগটি আরও বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য রোগও সৃষ্টি করতে পারে।

এ ছাড়া আমাদের সবার শরীরেই ব্যাকটেরিয়া (লিভিং মাইক্রোঅর্গানিজম) থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট অবস্থায় (যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে) তখন বাইরে থেকে সংক্রমিত ব্যাকটেরিয়ার (ননলিভিং মাইক্রোঅর্গানিজম) উপস্থিতি ঘটলে কী ঘটতে পারে, শরীরে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে তার কোনো সঠিক নির্দেশনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেই। যেকোনো মারাত্মক রোগের সৃষ্টিও হতে পারে। কিংবা এ রকম সময় ইমিউন সিস্টেমের (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কারণে মারাত্মক কিছু না ঘটলেও তা দুর্বল হতে থাকে। ফলে যেকোনো রোগের আক্রমণ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।

এদিকে পাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকর উপাদান নেই- বিএসটিআইর এমন দাবিতে জনগণের আতঙ্ক মোটেই কাটেনি। বরং সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট আরও বেড়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভোক্তা এবং বিভিন্ন ব্রান্ডের পাস্তুরিত দুধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে সে চিত্রই পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দুধ নিয়ে সাধারণ ভোক্তার উদ্বেগ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সামর্থ্যবানরা অনেকেই এরইমধ্যে এর বিকল্প জোগাড় করে ফেলেছে। আর যারা তা পারেনি, তারা অনেকে দুধ খাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে। এতে পাস্তুরিত দুধের বাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিশু বিশেষজ্ঞ জানান, সন্তানের চিকিৎসা নেয়ার সময় অধিকাংশ অভিভাবক দুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এর বিকল্প হিসেবে শিশুদের কী খাওয়াবেন তা জানতে চাইছেন।

একই ধরনের তথ্য দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের একাধিক পুষ্টি বিশেষজ্ঞও জানান, সব বয়সের রোগীই তার রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেয়ার পর দুধের বিকল্প কী খাওয়া যায় তা জানতে চাওয়ায় তারা এরইমধ্যে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেটাতে সহায়ক খাদ্যের তালিকা তৈরি করেছেন। যা রোগীদের সরবরাহ করছেন।

পুষ্টি বিজ্ঞানীরা জানান, দুধের তুলনায় ব্রম্নকলিতে বেশি ক্যালসিয়াম এবং সয়াতে প্রোটিন রয়েছে। এ ছাড়া অ্যামন্ড বা কাঠবাদাম দিয়ে দুধ বানানো যায়। এতে আলকালাইন রয়েছে। তবে এতে দুধের মতো প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম নেই। যদিও তা পূরণ করার জন্য এতে কলা বা খেজুর যোগ করা যেতে পারে।

এ ছাড়া সয়া দুধে গরুর দুধের চেয়ে আমিষের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। এতে লেসিথিন নামে এক প্রকার উপাদান আছে, যা স্মরণশক্তি বাড়াতে কাজ করে। অন্যদিকে প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর তিলও দুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। মাত্র ১ টেবিল চামচ তিলে ৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে। এ ছাড়াও এতে রয়েছে মিলারেলস, ভিটামিন, ফেনোলিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং প্রোটিন।

প্রসঙ্গত, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন ৭০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়। তবে ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের জন্য প্রতিদিন এক হাজার মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম দরকার। তরুণ বয়সে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি থাকলে তার প্রভাব পড়ে বৃদ্ধ বয়সে। বিশেষ করে ৫০ বছরের পর থেকে বেশ দ্রম্নত হাড় ক্ষয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তবে এ প্রবণতা নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি তৈরি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<59301 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1