শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চামড়ার কম দামে বিশাল ক্ষতি কওমি মাদ্রাসাগুলোর

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

প্রতি বছরই ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে ভীষণ মনোযোগী থাকে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো। আর চামড়া থেকে আসা অর্থ কওমি মাদ্রাসাগুলোর অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখে। এ অর্থ গরিব ছাত্রদের পড়ালেখা, থাকা-খাওয়ার পেছনে খরচ করা হয়। বরাবর এ সহযোগিতা পেলেও এবার কাঁচা চামড়ার দাম কম হওয়ায় বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কওমি মাদ্রাসাগুলো।

মাদ্রাসার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কওমি মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র গরিব। মাদ্রাসায় লিলস্নাহ বোর্ডিংয়ের বিশাল ব্যয় রয়েছে। এই বোর্ডিংয়ের মাধ্যমে দরিদ্র, অসহায়, এতিম শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে খাবার গ্রহণ করে। বছরের ৩ থেকে ৪ মাসের ব্যয় অর্থ সাধারণত কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির খাত থেকে আসত। কিন্তু এবার চামড়ার দাম কম হওয়ায় সেটা সম্ভব হবে না। ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও থাকা-খাওয়াতে ব্যাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রামপুরা জামিয়া কারিমিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মুফতি হেমায়েত বলেন, চামড়ার দাম কম হওয়ায় মাদ্রাসার বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। চামড়া থেকে আসা অর্থ দরিদ্র, অসহায়, এতিম শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ায় ব্যয় করা হতো। এবার হয়তো সেটা আর হবে না।

মুফতি হেমায়েত জানান, গত বছর ঈদুল আজহায় তার মাদ্রাসা ১ হাজার গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছিল। প্রত্যেকটি চামড়া ১ হাজার টাকা ধরে বিক্রি করা হয়েছিল। আর এবার ঈদে ১২শ'র ওপরে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু, চামড়া বিক্রির জন্য কোনো গ্রাহক না পেয়ে মাদ্রাসার খরচে গাড়ি ভাড়া করে একজন আড়তদারকে দিয়ে এসেছেন। তারা কোনো দাম দেয়নি। পরে বাজার দর অনুযায়ী টাকা দেয়া হবে এমন আশ্বাস দিয়েছেন আড়তদার।

রামপুরা নতুনবাগ জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ওয়ালিউলস্নাহ আরমান বলেন, চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের খরচের একটি অংশের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। এটা হয়তো খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু তারপরও চামড়া বিক্রির খাত থেকে এই টাকা আসত।

তিনি জানান, এবারের ঈদে তার মাদ্রাসা ৩৮১টি গরু চামড়া সংগ্রহ করেছিল। একজন পরিচিত ব্যক্তির কাছে তা ৫শ' টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তিনি আরও জানান, গত ঈদে তাদের মাদ্রাসা ২৮০টি গরুর চামড়া তুলে প্রতিটি সাড়ে ৮শ' টাকা দরে বিক্রি করেছিল। এবার চামড়া সংগ্রহ হয়েছে বেশি কিন্তু, দাম নেই। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি চামড়াতে ৩শ' টাকা করে ক্ষতি হয়েছে।

খুলনার জামিয়া ইসলামি আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আবুল কাসেম বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদে তারা ২৭০টি মতো গরুর চামড়া সংগ্রহ করে সাড়ে ৮শ' টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। এবার ২ শতাধিক গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। চামড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক খরচও হয়েছে। কিন্তু চামড়া বিক্রি করতে না পেরে খুলনার পরিচিত একটি আড়তদারকে বলা যায় বিনা পয়সায় দিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি কোনো অর্থ দিলে পাবেন, না হলে তো নেই।

কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সরকার চামড়া মার্কেটটাকে কিছু লোকের হাতে তুলে দিয়েছে। সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে না দেয়ার ফলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রসেসিং এবং ট্যানারিতে পাঠানোটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তখন মনোপলি এক কন্ট্রোল ট্যানারি মালিকদের হাতে চলে যায়। এ সুযোগটাই ট্যানারি মালিকরা নিয়ে সহজেই সিন্ডিকেট করে পানির দরে চামড়া কেনার সুযোগ নিচ্ছে। সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিলে ট্যানারি মালিকরা প্রতিযোগিতায় আসতে বাধ্য হবে। তখন কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে।

ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমির নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, 'গত ১০-১২ বছর আগেও এভাবে চামড়া সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল। তখন সরকার পক্ষে থেকে বলা হয়েছিল কাঁচা চামড়া এক্সপোর্ট করতে দেব। সাথে সাথে দাম উঠে গেল।'

সরাসরি কাঁচা চামড়া এক্সপোর্ট করার সুযোগ দিলেই চামড়া সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে উলেস্নখ করে কাসেমী বলেন, সংসদ থেকে শুরু করে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের প্রায় সকলেই কোনো না কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। যে কারণে এসব ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তে জনস্বার্থের চেয়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও চাওয়া-পাওয়াটা বেশি দেখা হয়। কোরবানির চামড়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়ে আসছে। না হয় ট্যানারি মালিকদের এই সিন্ডিকেট ভাঙা সরকারের জন্য কঠিন কিছু ছিল না।

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মুনির আহমদ বলেন, সরকার সাধারণ জনগণের নয়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে যত্নবান। সেটা ঈদের পরে কাঁচা চামড়া রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াতে আরেকবার প্রমাণিত হলো। কারণ, দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষের যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। ঈদের পরে কাঁচা চামড়া রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াতে আরও কিছু নতুন ব্যবসায়ী তৈরি হবে। আরও কিছু নতুন ধনী, অথবা আরও কিছু ধনবানের সম্পদ বৃদ্ধির পথ তৈরি হওয়া। কিন্তু, ঈদের পরের এই সিদ্ধান্তে কি চামড়ার প্রকৃত হকদার গরিব মানুষের কোনো উপকারে আসবে?

এদিকে চামড়ার মূল্য কম হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়লেও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোর। কারণ, কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট আলেমদের শীর্ষ ৫৫ জন নেতা হজ পালনে সৌদি আরবে রয়েছেন।

এ বিষয়ে খুলনার জামিয়া ইসলামি আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আবুল কাসেম বলেন, যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আলেমরা দেশে আসলে এ বিষয়ে একটা মিটিং করে পরবর্তীতে কী করা যায় তা হয়তো ঠিক করা হবে।

কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মক্তব, ফোরকানিয়া ও কোরানিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৩১টি। এই মাদ্রাসাগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। যাকাত, কোরবানির পশুর চামড়া ও চামড়া বিক্রীত অর্থ কওমি মাদ্রাসার আয়ের অন্যতম উৎস। শুধু এই ঈদুল আজহার সময়েই কোরবানির পশুর চামড়া থেকে কমপক্ষে চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62478 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1