শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু: আতঙ্কে জোয়ার সচেতনতায় ভাটা

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে আতঙ্কের জোয়ার বইলেও এ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক কার্যক্রমে নতুন করে ভাটার টান ধরেছে। বিশেষ করে যেসব পরিবার নিজেদের ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি বাড়ির আশেপাশে মশক নিধনে জোরালো ভূমিকা রাখছে, তারাও কোনো না কোনোভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে; তাদের অনেকেই এখন হতাশ। এছাড়া অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানাসহ যেসব কর্মস্থলে এডিস মশা ও এর লার্ভা নিধনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেখানকার কর্মজীবীরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম থেকে সরে এসে নিজেদের অদৃষ্টের হাতে সঁপে দিয়েছেন।

তাদের ভাষ্য, তারা বাসাবাড়িতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকলেও নোংরা-অপরিচ্ছন্ন কর্মস্থলে এডিস মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অফিসের গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফেরার সময়ও একইভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। এ অবস্থায় শুধু বাসাবাড়িতে সচেতন থাকলে ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই এ নিয়ে আতঙ্ক থাকলেও অযথা সময় নষ্ট করতে চাইছেন না অনেকেই।

তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় শুরু থেকেই এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির বসবাস, ওইসব এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে যথেষ্ট অসচেতন। রাজধানীর মুগদা, মান্ডা, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, শনির আখড়া, বাড্ডার নামা অঞ্চল, মেরাদিয়া ও বাসাবো এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বেশিরভাগ বাড়ির পানির মিটারের হাউসে স্বচ্ছ পানি জমে রয়েছে। এছাড়া অনেকের ছাদে এবং সেখানে রাখা ফুলের টবসহ বিভিন্ন পাত্রে জমা পানিতে এডিস মশার উপযুক্ত প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে এ নিয়ে তাদের প্রায় কারোরই তেমন কোনো ভ্রম্নক্ষেপ নেই। অথচ ডেঙ্গু আতঙ্কে তারা প্রায় সবাই তটস্থ। এদের কারো কারো ঘরে এক বা একাধিক ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। কেউবা হাসপাতালের বিছানায় মৃতু্যর সঙ্গে লড়ছেন।

নগরবাসীর এ অসচেতনার জন্য অনেকেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি।

সচেতন হওয়া বা করার ব্যাপারটি মুখের কথাতেই রয়ে গেছে। সরকার সবাইকে সচেতন হতে বলছে, কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কেউ পরিষ্কার করছেন না বা মশামুক্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না। সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে কিছু প্রচার-প্রচারণা চালানো হলেও তা মূলত শোডাউনের মধ্যেই গন্ডিবদ্ধ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ডেঙ্গু নিধনের চেয়ে 'বেস্নম গেমেই' বেশি তৎপর। ফলে বসতবাড়ির বাইরে বিভিন্ন ভবন, নির্মাণাধীন প্রকল্প, রাস্তাঘাট, বাস-লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পাত্রে বৃষ্টি কিংবা অন্য কোনো পানি জমে সেখানে এডিস মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। যা মোকাবিলা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে সচেতন নগরবাসীর ঘরে এডিস মশার উপদ্রব না থাকলেও অনেক সময় তা বাইরে থেকে উড়ে এসে তাদের কামড়াচ্ছে। এতে অনেকের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার আগ্রহ কমছে।

রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা একরামুল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের লোকদেখানো কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ সতর্ক হয়ে কী করবে।'

তার ভাষ্য, নগরবাসী নিজের ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি বাড়ির আশপাশের অংশে পড়ে থাকা কোনো পাত্র কিংবা অন্য কোথাও জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে কি না তা হয়তো খেয়াল রাখতে পারবে। কিন্তু রাস্তাঘাটের ছোটখাটো গর্ত ও সরকারি নির্মাণ প্রকল্প বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকলে তা কে পরিষ্কার করবে? লোকদেখানো সচেতনতামূলক কর্মসূচি থেকে সরে এসে সবাইকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে মালিবাগের একটি গার্মেন্টের সুইং অপারেটর শিউলি আকতার জানান, বিশাল গার্মেন্টে রাত-দিন তারা মশার কামড় খাচ্ছেন। অথচ মশক নিধনের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানালেই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী আলেয়ার ভাষ্য, শুধু সেখানকার গার্মেন্টেই নয়, গোটা ঢাকা শহরের হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক গার্মেন্ট ছাড়া কোথাও মশক নিধনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে বিজিএমইএর পক্ষ থেকেও কোনো নির্দেশনা নেই।

আলেয়া বেগম জানান, বিভিন্ন সময়ে বিপুল সংখ্যক কর্মী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ঢাকায় দেখভাল করার মতো কেউ না থাকায় তাদের অনেকেই বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ কারণে গার্মেন্টকর্মীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

ওই শ্রমিক নেত্রীর ভাষ্য, নিম্ন আয়ের অধিকাংশ কর্মী বস্তি এলাকায় বসবাস করেন। তাদের অনেকের ঘরের পাশেই ছোটখাটো ডোবা রয়েছে। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে গার্মেন্টকর্মীরা অনেকে এখনো মশারি কিনতে পারেনি। তাই তাদের ঘর ও কর্মস্থল দু'জায়গাই অনিরাপদ। অথচ এ ব্যাপারে কেউই কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ কর্মীই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছে বলে জানান শ্রমিক নেত্রী আলেয়া।

এদিকে শুধু গার্মেন্টই নয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই এডিস মশা এবং এর প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। কোথাও কোথাও সকালের দিকে এরোসল ছিটানো হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয়। দুয়েক দিন ঘটা করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা হলেও বেশিরভাগ কর্মস্থলে তা নিয়মিত করা হচ্ছে না। ফলে এডিস মশার বংশ বিস্তারের আশঙ্কা আগের মতোই রয়ে গেছে।

অন্যদিকে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকলেও তাদের মশারিতে ঢেকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলেও এর বাইরে মশক নিধন কিংবা এর প্রজননস্থল ধ্বংসের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাপারে সচেতন করারও বিশেষ কোনো কর্মসূচি নেই বলে খোদ চিকিৎসকরা স্বীকার করেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, 'রোগীর চিকিৎসা করাই তাদের কাজ; মশক নিধনের নয়।'

এ পরিস্থিতিতে খোদ হাসপাতালই যে এডিস মশার অন্যতম ঘাঁটি হয়ে উঠেছে তা সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সর্বশেষ মশা জরিপেই স্পষ্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে খুব বেশি পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। কীটতত্ত্ববিদেরা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮০ শতাংশ পাত্রে (পরিত্যক্ত কৌটা, বোতল, বালতি, জগ, কার্নিস ইত্যাদি) এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন। একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও।

এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, বস্তি ও রেলস্টেশনে যে অভিযান চালানো হয়েছে, তাতে প্রতিটি জায়গাতেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অথচ এসব স্থানে বিপুল সংখ্যক সচেতনতামূলক ব্যানার-ফেস্টুন রয়েছে। সেখানকার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনেককে বিভিন্ন প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে জোরালো বক্তব্য দিতেও দেখা গেছে।

অন্যদিকে সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার ৫০ হাজার পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে এডিস মশা ও এর লার্ভা ধ্বংস করে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে নগরবাসীকে সুরক্ষার আশ্বাস দিলেও এ লক্ষ্যে তারা কতটুকু তৎপর তা নিজেরাই ভালো বলতে পারবেন বলে খেদোক্তি প্রকাশ করেন নগরবাসী অনেকেই। তাদের ভাষ্য, ৩ আগস্ট ডিএমপি কমিশনার এ আশ্বাস দেওয়ার পর তাদের কারো চোখে মশক নিধনে পুলিশের বিশেষ কোনো তৎপরতা ধরা পড়েনি। তবে কোনো কোনো থানার ওসিকে স্থানীয় লোকবল নিয়ে শোডাউন করতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপকারীরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পস্নাস্টিকের বালতি, পস্নাস্টিকের ড্রাম, অব্যবহৃত টায়ার ও কর্ক শিট, ধাতব ড্রাম ও নারকেলের খোলায় ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদদের ভাষ্য, সক্রিয়তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সচেতনতাকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। অন্যকে করতে বলার চেয়ে নিজে করে দেখানোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এদিকে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে নগরবাসী চরম আতঙ্কে থাকলেও তাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম যে গতিতে চলছে, তাতে এর প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন হবে। শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু দমন করা যাবে না বলেও সাফ জানান দেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62638 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1