জামায়াত জোট সরকারের মদদ ছাড়া একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা সম্ভব হত না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওই হামলায় তার মৃত্যু হলে শোক জানানোর জন্য বার্তাও তৈরি করে রেখেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
২০০৪ সালের ২১ একুশে অগাস্ট ভয়াবহ ওই হামলার ১৫ বছর পূর্তিতে বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভায় একথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বারবার মানব ঢাল তৈরি করে তার জীবন বাঁচিয়েছেন জানিয়ে দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় বেঁচে থাকার কথা না। ওরাও ভাবেনি বেঁচে থাকব।
“ঘটনা অনেক জানি। যারা হামলা করেছে তারা এক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে ফোন করছে যে আমি মারা গিয়েছি কি না। খালেদা জিয়ার তৈরি করাই ছিল। আমি মারা গেলে একটা শোক জানাবে। সেটাও নাকি তার প্রস্তুত করা ছিল। কিন্তু আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।”
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বিকেলে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিল শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলার শিকার হন শেখ হাসিনা।
অস্থায়ী ট্রাকে বানানো মঞ্চে তার বক্তৃতার একেবারে শেষ পর্যায়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে আশপাশে। আকস্মিক সেই হামলার মুখে প্রাণ তুচ্ছ করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী আর দলীয় নেতা-কর্মীরা মানবঢাল তৈরি করেন। তাদের সেই দুঃসাহসিক চেষ্টায় সেদিন বেঁচে যায় বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রাণ।
সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
ওই ঘটনা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন একটার পর একটা গ্রেনেড বিস্ফেরিত হচ্ছে তখন কেউ বুঝতে পারেনি তাদের উপর আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে, যেটা যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।গ্রেনেডের স্প্লিন্টারগুলো এসে একে একে হানিফ ভাইয়ের মাথায়, গায়ে এসে লাগছে। আর সেখান থেকে রক্ত ঝরে আমার গায়ে পড়ছে। তিনটা গ্রেনেড মারার পর একটু বিরতি।
“এই ঘটনার পর তাদের ধারণা ছিল, আমি মারা গিয়েছি। কিন্তু এটা সামলে আমরা যখন গাড়িতে উঠতে যাব ঠিক সেই সময় আবার গুলি করা হল।”
হামলার পর সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গ্রেনেড হামলার পর পুলিশ আহত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে বরং টিয়ারশেল ছুড়েছিল, লাঠিচার্জ করেছিল।”
আক্রমণকারীরা যেন সহজে চলে যেতে পারে সেজন্য ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল বলে মনে করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সমাবেশে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেই ধরনের একটি গ্রেনেড পরে জেলখানায় পাওয়া যায় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা আক্রমণ করেছিল তাদের কাউকে কাউকে জেলখানা থেকেও সংগ্রহ করা হয়েছিল। যাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে চিকিৎসার কথা বলে এনে পরে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। নিশ্চয়ই একটা গ্রেনেড তাদের সাথে তখন সেখানে চলে যায়। তাহলে কত গ্রেনেড ছিল?
“পরে আরেকটা গ্রেনেড পাওয়া গিয়েছিল রমনা গার্ডেনের ভেতরে। পালানোর সময় তারা সেটা ফেলে রেখে যায়।”
হাসপাতালগুলোতে বিএনপিপন্থি কোনো চিকিৎসক আহতদের সেবা করেনি বলেও জানান তিনি।
হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে তদন্তের নামে যে প্রহসন হয়, তাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “হাই কোর্টের একজন বিচারপতিকে দিয়ে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যারা করেন সেটা ফরমায়েশি রিপোর্ট। সেখানে একটা সাধারণ মানুষ ধরে নিয়ে এসে তাকে আসামি করা হল। সেই নাকি ষড়যন্ত্রের হোতা। তখন জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়।”
অজ্ঞাতনামা যেই দুইজন মারা গিয়েছিল তাদের খোঁজ আর কেউ নেইনি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অর্থাৎ এটা সরকারের পক্ষ থেকে করা। এই ঘটনার পরের দিনই সিটি কপোরেশনের গাড়ি এনে ওই জায়গাটা ধোয়া হল। এই ঘটনার কোনো আলামত যেন না থাকে সেই চেষ্টাটা তারা করেছিল।
“ৃএই ধরনের একটা পরিস্থিতি দিনে দুপুরে কীভাবে ঘটতে পারে। সরকারে তখন যারা ছিল তারা, বিএনপি-জামাত জোটের মদদ ছাড়া এটা হতে পারে না।বিএনপি-জামাতের পৃষ্টপোষকতা ছাড়া এই ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব না। এটা আজকে প্রমাণিত সত্য। যার জন্য এতদিন পরে মামলার একটা রায় পেয়েছি। এখন উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সে যাবে। আশা করি এর বিচার হবে।”
এই হামলা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণেও বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ‘নেতৃত্বশূন্য’ করার লক্ষ্যেই ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদ- দেয় আদালত। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকেও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, বার বার হামলার শিকার হলেও মৃত্যু ভয় তিনি করেন না। এদেশের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নে কাজ করে যাবেন।
“মৃত্যুতো যখন তখন হতে পারে। মানুষ যেদিন জন্মাবে সেদিনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু না আসবে যতটুকু কাজ করার করে যাব। এই হচ্ছে আমার কথা। মৃত্যু আসবে এটা অবধারিত। জানি। কিন্তু সেই মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে বসে থাকব না। লোভ লালসা নিয়ে সম্পদের দিকে ছুটব না।”
সভায় অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাহারা খাতুন, আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এস এম কামাল হোসেন, দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।