মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে নতুন ছক

শক্তিশালী তরঙ্গ প্রতিরোধকযন্ত্র বসছে ৩৪ ক্যাম্পে মিয়ানমারের সিমের নেটওয়ার্ক নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ বন্ধ হচ্ছে ফ্ল্যাক্সিলোড ও প্রিপেইড কার্ড বিক্রি কাঁটাতারের বেড়ার বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার
সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের এক সমাবেশ -ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মোবাইল সেবা সাত দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হলেও নির্ধারিত সময়ের পরও এ ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মোবাইল অপারেটররা। তাই অনেকটা আগের মতোই মোবাইল ফোনে কথা বলছে রোহিঙ্গারা। এমনকি বিকেল ৫টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত যে ১৩ ঘণ্টা থ্রিজি ও ফোরজি সেবা পুরোপুরি বন্ধ রাখার কথা ওই সময়ও তারা নির্বিঘ্নে দেশ-বিদেশে ভিডিও কল করছে। অনলাইন টেলিভিশন, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক অব্যাহত রেখেছে। অনলাইনের সেসব পস্ন্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলা, আরাকান ও বার্মিজ ভাষায় নিয়মিত নিজেদের 'বার্তা' এবং বেশকিছু উসকানিমূলক ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা।

এছাড়া অনলাইন নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ইয়াবা পাচারসহ নানা অপরাধ নিয়মিত সংঘটিত হচ্ছে। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গুরুত্ব বিবেচনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসুরক্ষার স্বার্থে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধার অপব্যবহার করতে না পারে এ জন্য কৌশলী পথ বেছে নিচ্ছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার ও উখিয়ার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে হাই ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার (উচ্চ শক্তিশালী তরঙ্গ প্রতিরোধক যন্ত্র) বসানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গা ৩৪টি ক্যাম্পে কতটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জ্যামার লাগাতে হবে, এতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হবে এবং এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কী ধরনের সুবিধা-অসুবিধা সৃষ্টি হবে- প্রাথমিক পর্যায়ে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা বিদেশি এনজিওদের নিয়মিত কার্যক্রম কতটা বাধাগ্রস্ত হবে তা যাচাই করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এ প্রযুক্তি ব্যবহারে

আশানুরূপ সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া না গেলে ভিন্ন প্রযুক্তিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে মোবাইল অপারেটররা তাদের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ না করলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে আগের মতো সহজেই মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনালাপ কিংবা ডাটা ব্যবহার করে ভিডিও কল করতে না পারে এজন্য ফ্ল্যাক্সিলোড ও প্রিপেইড কার্ড বিক্রি বন্ধেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, এতে মোবাইলের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ না হলে এ ব্যাপারে যথেষ্ট কড়াকড়ি আরোপ করা সম্ভব হলে তা বেশকিছুটা কমবে। কেননা, ফ্ল্যাক্সিলোড কিংবা প্রিপেইড কার্ড কিনতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। কিংবা এজন্য তাদের ভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করতে হবে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমাবদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের অবস্থানও নির্ধারিত গন্ডিতে আবদ্ধ করারও কৌশলী পথ খুঁজছে সরকার। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, রোহিঙ্গারা মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ পেলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তাতে তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, একপর্যায়ে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া বা সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কথা বললেও এর বিকল্প কোনো কৌশলী পথ খোঁজার সুপারিশ করেছেন গোয়েন্দারা। তাদের ভাষ্য, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের গন্ডিবদ্ধ করে রাখা গেলেও দুর্ধর্ষ ও অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরা বাস্তবিক অর্থে কঠিন হবে। তাই অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের পায়ে কৌশলী বেড়ি পরানোরও উপায় খুঁজে বের করাই সমীচীন বলে মনে করেন তারা।

কক্সবাজার ও উখিয়ার স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর ও বাইরে আগের মতোই সিমকার্ড বেচাকেনা চলছে। এমনকি পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন দোকানে সিম বিক্রি হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। তবে একাধিক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা দেননি। এ কারণে তারা সিম বিক্রি বন্ধে সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ করছে না।

অন্যদিকে শুধু দেশীয় সিম বিক্রি বন্ধ এবং বিকেল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত থ্রিজি ও ফোরজি সেবা অচল করে দেয়া হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মিলবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান গোয়েন্দারা। তারা জানান, বিপুলসংখ্যক শরণার্থী রোহিঙ্গার কাছে মিয়ানমারের সচল সিম রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা অনেকে তাদের সে দেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নির্বিঘ্নে কথা বলছে। এমনকি এ সিম দিয়ে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভিডিও কলেও কথা বলছেন তারা। তাই দেশীয় অপারেটরদের দিয়ে তাদের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হলেও মিয়ানমারের সিম দিয়ে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর-বাইরে, এমনকি বহির্বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সচল রাখতে সক্ষম হবে।

অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারগুলোর আওতা মিয়ানমারের ভেতরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নেটওয়ার্কের কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিমকার্ড ব্যবহার হচ্ছে মিয়ানমারের ভেতরেও। তাই সব অপারেটরের টাওয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে না নিলে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে আনা দুষ্কর হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে হাই ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার বসানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিটিআরসির একাধিক তরঙ্গ প্রকৌশলী। তারা জানান, জ্যামার সচল রাখতে বৈদু্যতিক সংযোগ প্রয়োজন। যা জেনারেটরের মাধ্যমে বিকল্পভাবে সরবরাহ করা যেতে পারে। তবে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ ব্যবস্থা সচল রাখা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

কারাগারে বন্দি দুর্ধর্ষ অপরাধীরা কারা অভ্যন্তরে বসে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বেশ কয়েকটি কারাগারে জ্যামার বসানো হলেও সে টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে ওই প্রকৌশলীরা বলেন, এ ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক সচল রাখতে বেশকিছু বিকল্প ইনসট্রুমেন্ট প্রয়োজন। যা কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারেনি। এ কারণে সেখানে উচ্চ শক্তিশালী তরঙ্গ প্রতিরোধ যন্ত্র বসানো হলেও তা যথেষ্ট কাজে লাগেনি। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জ্যামার বসানোর আগে এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

প্রসঙ্গত, জ্যামার মেশিন চালু থাকলে নির্ধারিত সীমানার মধ্যে মোবাইল ফোনের ফ্রিকোয়েন্সি বা নেটওয়ার্ক কাজ করে না। এ সময় ওই সীমানার মধ্যে কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারে না।

এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জ্যামার বসানোর বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কেউ সরাসরি কোনো কথা বলতে চাননি। তবে প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, শুধুমাত্র অপরাধ ও উসকানিমূলক অপতৎপরতা রোধেই রোহিঙ্গা শিবিরে জ্যামার বসানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর নেপথ্যে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। একই উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি জ্যামার লাগানোর নজির রয়েছে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না বলেও দাবি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66255 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1