নোনা ইলিশের কদর বৃহত্তর চট্টগ্রামেই বেশি। তবে এখন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে এই মাছ। পচনশীল বলে খুব দক্ষতার সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হয় ইলিশ। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরে লবণ দিয়ে ইলিশ সংরক্ষণ করেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
নগরের ফিশারিঘাট ও কাট্টলী রানি রাসমনি ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মৎস্যজীবীরা ছোট-বড় আকারের ইলিশ লবণ দিয়ে সংরক্ষণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। টিনের ঘরে ১০-১২ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিক ইলিশ কাটা, পরিষ্কার করা এবং লবণ দেয়ার কাজ করছেন।
রাসমনি ঘাট এলাকায় নোনা ইলিশ তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিক শেফালী খাতুন (৪৫) বলেন, কাজ করছি ১৮ দিন ধরে। দিন শেষে পাই ৫০০ টাকা। পুরুষরা পায় ৭০০ টাকা।
কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, লবণ জীবাণুনাশক ও জীবাণু প্রতিরোধের কাজ করে। শুষ্ক লবণায়ন পদ্ধতিতে প্রথমে মাছের আঁশ ও পাখনা দেহ থেকে সরানো হয়। এরপর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে পানিতে ধুয়ে মাছটির পিঠের দিক থেকে বুক পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে কেটে ফেলা হয়। কাটা মাছের দেহের বাইরে ও ভেতরে হাত দিয়ে কয়েকবার ঘসে ভালোভাবে লবণ মাখিয়ে দিতে হয়।
'আঙুল দিয়ে চেপে চোখ ও ফুলকার ভেতরে লবণ ঢুকিয়ে দিতে হবে। শতকরা ২৫ ভাগ লবণ দিয়ে মাছ লবণজাত করা হয়। লবণমিশ্রিত মাছ বাঁশের ঝুড়ি বা কাঠের পাটাতনের ওপর স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হয়। প্রতি স্তরে হালকা লবণের ছিটা দিতে হয়। এরপর মাছগুলো মাদুর বা গোলপাতার চাটাই দিয়ে ঢেকে ১০-১৫ দিন রাখতে হয়। একে রাইপেনিং বলে। পানি ঝরে গেলে লবণজাত মাছগুলো টিনের কৌটায় রেখে গুদামজাত করা হয়। সাধারণত ইলিশ মাছ লবণজাত করে সংরক্ষণ করা হয়। মাছ লবণজাত হতে ১৫-২০ দিন সময় লাগে'।
সারা বছর নোনা ইলিশ সংরক্ষণ করতে চাইলে ডিপ ফ্রিজে রেখে দেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাদামি রঙের কাগজের ঠোঙাতে পেঁচিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। পস্নাস্টিক বা পলিথিনে সংরক্ষিত খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর এভাবে সংরক্ষণ করলে ফ্রিজের অন্য উপাদানে নোনা ইলিশের গন্ধ ছড়াবে না।
জানা গেছে, লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা প্রতি কেজি ইলিশ বাজারে বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা বা ততোধিক দামে। লাভজনক হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন এ ব্যবসায়। এক বছরে বিক্রি না হলেও দেড় বছর রেখেও বিক্রি করা যায় নোনা ইলিশ।
তবে নোনা ইলিশ সংরক্ষণের ৫ থেকে ৬ মাস পর খেলে তা থেকে পেটের অসুখ, ডায়রিয়া ও চর্মরোগ হতে পারে। এছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের জন্যও নোনা ইলিশ ক্ষতিকারক বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী।
ফিশার ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী দুর্যোধন দাশ বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিলস্নাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় নোনা ইলিশ সরবরাহ করা হয়। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশেও নোনা ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে।
রসনাপ্রিয় বাঙালির পাতে এখন নোনা ইলিশ বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। কুমড়ো বা লাউ পাতা দিয়ে নোনা ইলিশের টুকরো মুড়িয়ে ভাজি করে খান অনেকে। আবার নোনা ইলিশ ভুনা বা বিভিন্ন সবজি দিয়েও প্রক্রিয়াজাত এই ইলিশের তরকারি রান্না করা যায়।
রন্ধনশিল্পী জাকিয়া মম জানালেন ইলিশ ভুনা তৈরির পদ্ধতি। ১টি নোনা ইলিশের জন্য প্রয়োজন হবে ১ কাপ পেঁয়াজ কুচি, ১ কাপ রসুন মোটা কুচি, ৩টি টমেটো কুচি, ৮-১০টি কাঁচামরিচ, ১ চা চামচ করে হলুদ, মরিচ, ধনে গুঁড়ো, ১ চা চামচ আস্ত জিরা, ২ চা চামচ করে আদা ও রসুন বাটা, সরিষার তেল, সাদা তেল প্রয়োজন মতো ও পরিমাণমতো লবণ।
এরপর মাছ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হবে। নরম হলে আঁশ ও ময়লা পরিষ্কার করে বেশ কয়েকবার পানি পরিবর্তন করে ধুয়ে নিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে একটি কড়াইয়ে তেল গরম করে জিরা ফোঁড়ন দিয়ে ব্রাউন করে পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে। পেঁয়াজ ভাজা হলে টমেটো দিতে হবে। টমেটো নরম হয়ে গেলে অল্প পানিতে অন্যান্য মসলাগুলো কষিয়ে নিতে হবে। মসলা থেকে তেল ছেড়ে আসলে রসুন ও কাঁচামরিচ মিশিয়ে তার ওপর সমান করে মাছের টুকরো বিছিয়ে দিতে হবে।
চুলার আঁচ একদম কমিয়ে দিতে হবে। বাড়তি পানি দেয়ার দরকার নেই। তাহলে মাছ গলে যেতে পারে। মাছের পানি দিয়েই মাছ কষানো হয়ে যাবে। খুব সাবধানে কয়েকবার মাছ উল্টিয়ে উল্টিয়ে রান্না করতে হবে। তেল ছেড়ে এলে আস্ত কাঁচামরিচ ও ওপরে সরিষার তেল ছড়িয়ে উনুন থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে।