শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
ফারমার্স ব্যাংক

কর্মচারীর নামে কোম্পানি খুলে ১১৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ

অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, মাহবুবুল হক চিশতী অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ভাইকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার কমিশন নতুন করে এই মামলার অনুমোদন দেয়।

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় এর আগে পাঁচটি মামলা হয়েছে। দুদক সূত্র জানিয়েছে, অনুমোদন হওয়া মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৮৮ কোটি ১৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হচ্ছে। সুদসহ ওই টাকা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার। মামলায় ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হচ্ছে। দুদক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

মামলায় আসামি করা হচ্ছে আটজনকে। তারা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী, তার ভাই মাজেদুল হক ওরফে শামীম চিশতী, ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম এম শামীম, শাবাবা অ্যাপারেলসের মালিক মো. আবদুল ওয়াদুদ ওরফে কামরুল, এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিংয়ের মালিক রাশেদ আলী, তনুজ করপোরেশনের মালিক মো. মেফতাহ ফেরদৌস, মোহাম্মদ আলী ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. গোলাম সারোয়ার ও ক্যানাম প্রোডাক্টসের মালিক ইসমাইল হাওলাদার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাহবুবুল হক চিশতীর ভাই মাজেদুল হক চিশতী তার কর্মচারী আবদুল ওয়াদুদকে মালিক সাজিয়ে শাবাবা অ্যাপারেলস নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানটি ফারমার্স ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ফান্ডেড ঋণসুবিধা নেয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নন-ফান্ডেড ১৫ কোটি টাকা সুবিধার পরিবর্তে ৩৯ কোটি ৯ লাখ ৬ হাজার টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়, যা সুদাসলে ৪৫ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা দাঁড়ায়। এ বিষয়ে ব্যাংকটির সাবেক এমডি কোনো ব্যবস্থা নেননি। ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালক মাহবুবুল হক চিশতী তাঁর ভাইয়ের মাধ্যমে নিজেই সুবিধাভোগী ছিলেন।

একইভাবে মাজেদুল হক চিশতী আরেক কর্মচারী রাশেদ আলীকে মালিক সাজিয়ে এডিএম ডাইং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এর মাধ্যমে ১৭ কোটি টাকা ঋণসুবিধার পরিবর্তে ৫৫ কোটি ৫ লাখ ১১ হাজার টাকা ঋণ নেন।

মাজেদুল হক চিশতীর কাছে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাগাদা দিলে তিনি পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও পরে পরিশোধ করেননি। অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, মাহবুবুল হক চিশতী অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ভাইকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া ব্যাংকটির এমডি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন।

চিশতী পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ

সম্প্রতি মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর স্ত্রী ও ছেলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে দুদক। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ ইমরুল কায়েশ এ-সংক্রান্ত আদেশ দেন।

আদেশে বলা হয়, দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম আদালতে এ-সংক্রান্ত আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোতে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব হিসাব থেকে টাকা বেরিয়ে গেলে অনুসন্ধানকাজ ব্যাহত হবে। তাই এসব হিসাব ফ্রিজ করা জরুরি। দুদকের কর্মকর্তার আবেদনের ওপর ভিত্তি করে আদালত মোট ছয়টি হিসাব ফ্রিজ করার আদেশ দেন।

জব্দ হওয়া হিসাবের মধ্যে মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর পরিচালনায় চারটি, রাশেদুল হক চিশতী ও তার মা রোজী চিশতী একটি পরিচালনা করেন। আরেকটি হিসাব বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্সের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সাইফুল ইসলাম মাতব্বরের। রাশেদুল হক চিশতীর পরিচালনায় যে চারটি হিসাব জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো হলো মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বনানী শাখায় আরসিএল পস্নাস্টিকস, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায় বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স, ডাচ্‌?-বাংলা ব্যাংকের পলস্নবী শাখায় আরসিএল পস্নাস্টিকস ও যমুনা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ফিউশন ফুটওয়্যারসের। যমুনা ব্যাংকের মহাখালী শাখায় বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্সের জব্দ হওয়া হিসাব পরিচালনা করেন রোজী চিশতী ও রাশেদুল হক চিশতী। সাইফুল ইসলাম মাতব্বরের জব্দ হওয়া ব্যাংক হিসাব স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায়।

প্রথম মামলায় অভিযোগপত্র

দুদক বলছে, ফারমার্স ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান চলছে। এর আগে পাঁচটি মামলাও হয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল করা মামলায় অভিযোগপত্রও দিয়েছে সংস্থাটি। মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী) পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। চিশতী ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন মাহবুবুল হক চিশতীর স্ত্রী রোজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ফারমার্স ব্যাংকের চাকরিচু্যত এসভিপি জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও চাকরিচু্যত ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান।

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে নথিপত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক যাত্রা শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকটে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে পদ ছাড়তে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71068 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1