শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় সম্রাটের 'সেকেন্ড হোম' শনাক্ত

৪৩ জনের তালিকা এখন দুদকের হাতে এর মধ্যে যুবলীগের ২০ নেতার নাম রয়েছে
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট

অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৩ জনের তালিকা এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ নামগুলো পেয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠানটি। এ তালিকায় যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ সংগঠনটির বিভিন্ন স্তরের জনাবিশেক নেতার নাম রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সূত্র বলছে, এসব নেতার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও নামে-বেনামে সম্পদের প্রমাণ হাতে পেয়েছে কমিশন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অননুমোদিত ক্যাসিনোতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছের্ যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর থেকেই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় শুরু করে দুদক। এর অংশ হিসেবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ওর্ যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছে দুদক। সেই সঙ্গে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটও অনুসন্ধান চালিয়ে আসছিল। এ চার সংস্থার তথ্যের সমন্বয়ে দুদক ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও বেনামি সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি বা মালয়েশিয়ার মাই সেকেন্ড হোমে (এমএম ২ এইচ) অংশ নিয়েছেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সেখানকার আমপাংয়ের তেয়ারাকু-তে তার একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকেও তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে নিয়মিত লেনদেনের প্রমাণও পেয়েছে দুদক।

এ তালিকায় সম্রাটের পরেই রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক ও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আগেই তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। অভিযান শুরুর পর তিনি এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। এ অবস্থায় ডিএসসিসির সভায় যোগ না দেওয়ার অভিযোগে তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

তালিকায় আরও রয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু ও সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। এদের বেশিরভাগই গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং যুবলীগের পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, সম্রাটসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধেই বিদেশে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে অভিযুক্তরা অর্থপাচার করেছেন। এর পাশাপাশি এসব দেশে নামে ও বেনামে সম্পদও গড়েছেন। যার প্রমাণ এখন দুদকের হাতে।

এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত সোমবার (১৪ অক্টোবর) সাংবাদিকদের

বলেন, জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৩ জনের নাম প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেওয়া হচ্ছে তাদের অর্জিত সম্পদের বিবরণী। তারা যদি তাদের সম্পদ বিবরণী সঠিকভাবে জমা দিতে না পারেন, তাহলে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার আইনে মামলা হতে পারে।

উলেস্নখ্য, ২০০২ সালে চালু হওয়া মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি বা মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমরা এমএম ২ এইচ হলো এমন একটি কর্মসূচি, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে অন্য দেশের একজন নাগরিক মালয়েশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও অন্যান্য সুবিধা পান। বিভিন্ন দেশ থেকে এ কর্মসূচিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪২ হাজার ২৭১ জন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা চার হাজার ১৩৫ জন।

এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও জাপান।

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নিবাস গড়তে বৈধভাবে অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক সার্কুলারে দেশের বাইরে কোনো স্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে যারা অংশ নিয়েছেন তারা টাকা পাচার করেছেন।

বাংলাদেশিরা সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শুরু করে ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর ৩২ জন বাংলাদেশি এতে অংশ নেয়। পরের বছর সংখ্যাটি ৬ গুণ বেড়ে ২০৪ জনে উন্নীত হয়। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেয় ২০০৫ সালে। ওই বছর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৮৫২ জন। এরপর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে অংশ নেওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা বছরে ১০০ জনের কম ছিল। পরে তা বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে ২৮৩ জন বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরের বছর তা দাঁড়ায় ৪৫১ জনে। অবশ্য ২০১৮ সালে এ সংখ্যা কমে গিয়ে ১৯১ জনে দাঁড়িয়েছে। সেকেন্ড হোম প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি মাসে ১০ হাজার রিঙ্গিত বা দুই লাখ টাকা বৈদেশিক আয় দেখাতে পারলেই পাওয়া যায় মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ। যে কোনো দেশের নাগরিক এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ জন্য স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত জমা রাখতে হয়। তবে দ্বিতীয় বছরে অর্ধেক অর্থ তুলে নিতে পারেন সুবিধা গ্রহণকারীরা।

অর্থ পাচার করে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি অভিযোগ ২০১৫ সালের শুরুর দিকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথম পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও পরে এ অভিযোগের সঙ্গে অনেকের নাম পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিএফআইইউ থেকে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়।

এর মধ্যে এসবির তালিকায় ১০ হাজার ৯০৪ জন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ১৩ জনের নাম ছিল। দুদককে দেওয়া এসবির নথিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই ১০ হাজার ৯০৪ জন মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেছেন। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণসহ ১৩ জনের তালিকা দিয়েছিল বিএফআইইউ।

তিন বছরের বেশি সময়ে দুদকের একাধিক টিম অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ উপ-পরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) মো. জুলফিকার আলীর নেতৃত্বাধীন টিম অনুসন্ধান করে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা থেকে ২৩ জনকে চিহ্নিত করে। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে এসবির নথিপত্র যাচাই করে। বিফআইইউর নথি যাচাই করে চিহ্নিত করা হয় ১১ জনের নাম।

ওই ২৩ জনের তালিকায়ও সম্রাটের নাম ছিল। অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদনে সম্রাটসহ ওই ২৩ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছিল। বিনিয়োগ করা অর্থের উৎসসহ বিস্তারিত তথ্য জানতে দুদক বেশ কয়েকবার মালয়েশিয়ায় আইনগত সহায়তা অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠিয়েও সঠিক জবাব পায়নি। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরও অজানা কারণে ওই অনুসন্ধান অনেকটা আড়ালে থেকে গেছে।

অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে অনুসন্ধান দল গঠন করেছে দুদক। ৩০ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি। তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের কাজ করছেন অনুসন্ধান দলের সদস্যরা।

এরই মধ্যে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে থাকা এলিট ফোর্স র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র?্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক হয়েছে দুদক চেয়ারম্যানের। বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসানও বৈঠক করেছেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। দুই বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের নানা গোয়েন্দা তথ্য হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রামে এক বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করের্ যাব। পরে তাকে নিয়ে ঢাকায় কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানসনের কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। তলস্নাশি চালানো হয় শান্তিনগরে সম্রাটের ভাইয়ের বাসা ও ডিওএইচএসে সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায়। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অস্ত্র এবং মাদক রাখায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করা হয়।

উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গেস্নাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে দুটি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। একই সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71229 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1