বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আরেক 'জাহালম' বাবলু শেখের গল্প

যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
বৃহস্পতিবার নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর স্বজন ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাবলু শেখ (মাঝে ফিরোজা রঙের শার্ট পরিহিত) -যাযাদি

তিনি মাসের পর মাস হাজত খেটেছেন। ১৭ বছর ধরে আদালতে ঘুরছেন। শ্রী বাবু নামের এক আসামির পরিবর্তে তাকে এই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এই ব্যক্তি হলেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার আচলকোট গ্রামের বাবলু শেখ (৫৫)।

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সিদ্দিক বৃহস্পতিবার সকালে বাবলু শেখকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন।

একই সঙ্গে আদালত দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রায় কার্যকর করে তা আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করারও নির্দেশ

দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বাবলু শেখের ঘটনাকে বহুল আলোচিত 'জজ মিয়া' ও 'জাহালম'-কান্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বিচারক প্রকাশ্য আদালতে রায় পড়ে শোনান। এ সময় আদালতে ভুক্তভোগী বাবলু শেখ, তার স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও উৎসুক এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

বিচারক তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, বাবলু শেখ বহুল আলোচিত 'জজ মিয়া' ও 'জাহালম'-এর প্রতিচ্ছবি। তিনি বংশ পরম্পরায় একজন মুসলমান হলেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা শ্রী বাবু হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন। গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে গেলে সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসামিকে পরীক্ষা না করেই চালান বইয়ে স্বাক্ষর করে অন্যায় করেছেন। যদিও আদালতের নথিতে রহস্যজনকভাবে ওই চালানের কপি সংযুক্ত নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আদালতও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বিচারক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সিদ্দিক বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোমিনুল ইসলাম ও এসআই হেলেনা পারভিন ভুল আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করেননি। পরবর্তী সময়ে নিযুক্ত আইনজীবীরা বিষয়টি জানলেও সে ব্যাপারে আদালতে প্রতিকার চেয়ে তথ্য-প্রমাণসহ দরখাস্ত করেননি। তারা ভুল নামেই বাবলু শেখের জামিন করেছেন। শুনানির সময় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কথা বলা হলেও সে মর্মে কাগজপত্র নথিতে পাওয়া যায়নি। আদালত একটি আদেশে ভুল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এসআই হেলেনা পারভিন তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আদালতে জমা দেননি। আদালতও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বিচার চলাকালে আসামিকে পরীক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়ার সমালোচনা করেন এই বিচারক।

পর্যালোচনা শেষে আদালত বাবলু শেখকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন। একই সঙ্গে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, থানার ওসি ও গ্রেপ্তারে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাবলু শেখ ইচ্ছা করলে এই রায়ের কপি নিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য উচ্চ আদালতেও যেতে পারেন বলে আদালত মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রায়ের কপি নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি), ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ ও আইজিপি বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিচারক এ ঘটনায় আইনজীবী ও আদালতকে আরও সতর্ক হওয়ার কথা বলেন। তবে মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় বহাল রাখা হয়। ওই রায় মোতাবেক মূল আসামি শ্রী বাবুর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করার নির্দেশ দেন আদালত।

রায় ঘোষণার পর বাবলু শেখ সাংবাদিকদের বলেন, তিনি একজন দিনমজুর। অথচ তাকে ভুলের খেসারত টানতে হয়েছে ১৭ বছর। কয়েক মাস এ মামলায় সাজাও খেটেছেন তিনি। এ ধরনের ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেন তিনি।

নাটোরের এসপি লিটন কুমার সাহা বলেন, রায়ের কপি তিনি হাতে পাননি। রায়ের কপি হাতে পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

আদালতের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামের কাজী আবদুল মালেকের সঙ্গে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মালেক বাদী হয়ে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নাটোর থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি শ্রী বাবুকে গ্রেপ্তার না করে একই গ্রামের বাবলু শেখকে ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে নাটোর সদর আমলি আদালতে পাঠান। ভুলের বিষয়টি আদালতকে অবহিত না করে ছয় দিন পর ১৩ নভেম্বর আসামির আইনজীবী শ্রী বাবু পরিচয়েই বাবলু শেখের জামিন করান। পরে ওই পরিচয়েই বাবলু শেখের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন মুখ্য বিচারিক হাকিম মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী আসামি বাবুলকে দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেন। ওই দিন কাঠগড়া থেকে বাবলু শেখকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে বাবলু শেখ আপিল করেন। আদালত তাকে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত জামিন দেন। মামলাটি শুনানির জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এলে আদালত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71634 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1