বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্টে যাচ্ছে আ'লীগের তৃণমূলের চিত্র

মাত্র ক'দিন আগেও যেসব দাপুটে নেতার সঙ্গ পেতে শত শত কর্মী উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, ওইসব নেতার অনেকেই এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসায় গোটা দলের তৃণমূলের চিত্র দ্রম্নত পাল্টে যাচ্ছে। মাত্র ক'দিন আগেও যেসব দাপুটে নেতার সঙ্গ পেতে শত শত কর্মী উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, ওইসব নেতার অনেকেই এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তাদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ কর্মীরা কেউ কেউ এখন সততার লেবাস পরে নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন।

এদিকে দুর্নীতিবাজ নেতাদের সহযোগী হিসেবে যেসব ক্যাডার দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত তারা সে সুযোগ পাওয়ার আশা ছেড়ে নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দলে কোন্দল সৃষ্টির আগাম পাঁয়তারা করছেন। স্থানীয় নেতৃত্বে আগামীতে যাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তারা দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনায় ব্যর্থ হবেন- গোপনে কেউ কেউ এ ধরনের প্রচারণাও চালাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পরিবর্তন না এলেও দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত নেতাদের অবস্থান আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা তারা ভালোভাবেই টের পেয়ে গেছেন। তাই তারা অনেকে আগেভাগেই নিজেকে স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নিচ্ছেন। এ সুযোগে মহানগর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কোণঠাসা হয়ে থাকা ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা ফ্রন্ট লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। দলের দুঃসময়ে তাদের সাহসী ভূমিকা পর্যালোচনা করে আগামীতে যোগ্য মূল্যায়ন পাবেন এ ব্যাপারে তারা ভীষণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। ফলে সারা দেশেই মাঠপর্যায়ের নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙাভাব স্পষ্ট-দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পুরানো কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে নতুনভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন পর্যন্ত-এই সময়টুকু যথেষ্ট 'স্পর্শকাতর' বলে মনে করেন দলের প্রবীণ নেতারা। তাদের ভাষ্য, পুরানো কমিটির দুর্নীতিবাজ বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে হলে দলীয় হাইকমান্ডকে যথেষ্ট তৎপর হতে হবে। তা না হলে বিতর্কিত নেতারা দলের ভেতরে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে। দুর্বল এ সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানা ধরনের ফন্দি এটে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে বিপাকে ফেলতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

এদিকে দক্ষ ও সৎ নেতারা বিতর্কিত নেতাদের স্থলাভিষিক্ত হলেও তারা যাতে ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকে পুরোপুরি ছিটকে না পড়েন এ জন্য তাদের গডফাদাররা আগাম তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। দলের মাঠপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিভিন্ন সময়ের বিতর্কিত নেতাদের ঠাঁই করে দিতে দলীয় গডফাদাররা নানা ছক কষছেন। তাদের পছন্দের ওইসব নেতাকে কমিটিতে পদ দেওয়া না হলে ভবিষ্যতে কী ধরনের অসুবিধা হতে পারে তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি তাদের পছন্দে গুরুত্ব দেওয়া না হলে আগামীতে তারাও তাদের মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নেবেন, রাজনৈতিক গডফাদাররা এমন ইঙ্গিতও দিচ্ছেন।

এ ধরনের অভিযোগ যে একেবারে অমূলক নয়, তা স্বীকার করে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একজন নেতা বলেন, প্রভাবশালী নেতারা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রভাব বিস্তার করেন। এর ধারাবাহিকতায় এবারও তারা তাদের পছন্দের লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাইয়ে দিতে নানাভাবে লবিং করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এবার এ ধরনের সুযোগ খুবই কম। স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও মৎস্যজীবী লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও এবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হতে হবে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি এসব পদে পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের নির্বাচন করবেন। তৃণমূল কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করা হবে। তাই পলিটিক্যাল গডফাদাররা তাদের পছন্দের লোকজন কমিটিতে ঢোকানোর যতই চেষ্টা করুক না কেন, তারা কেউ দুর্নীতিবাজ কিংবা বিতর্কিত হলে দলে পদ পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে। এমনকি রাজনৈতিক এসব গডফাদারের ক্ষমতাও অনেক কমিয়ে আনা হবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীল ওই আওয়ামী লীগ নেতা।

দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোতে কেউ যেন সিন্ডিকেট তৈরি করতে না পারে সে ব্যাপারে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এবার অনেক বেশি সতর্ক। নতুন কমিটিতে যাদের পদ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের নামের তালিকা তিনি নিজস্ব টিম দিয়ে সংগ্রহ করছেন। পরে তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা অনুসন্ধান চালানো হবে। এতে যদি তারা দুর্নীতিবাজ কিংবা বিতর্কিত প্রমাণ না হন, তাহলে আরও কয়েকটি ধাপ পার করতে হবে। এই ধাপের মধ্যে রয়েছে, তাদের অতীত কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হবে। দলের সংকটময় সময় তাদের কী ভূমিকা ছিল এবং তারা দলের কোনো গ্রম্নপিংয়ে সম্পৃক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। সর্বোপরি তারা দলে অন্তত দশ বছর যুক্ত আছেন কিনা এবং এ সময়ে কোনো ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন কিনা তা নিরূপণের ভিত্তিতে পদ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। তাই বিগত সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা সন্ত্রাস-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, তারা এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

তবে মাঠপর্যায়ের বেশকিছু সূত্র এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছে। তাদের দাবি, দুর্নীতিবাজ বিতর্কিত নেতাকর্মীরা ক্ষমতার বলয় থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়ার যে শঙ্কা এতদিন বহাল ছিল, তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে শুদ্ধি অভিযানের স্থবিরতার কারণে তারা নতুন করে উদ্দীপনা ফিরে পেয়েছেন। বিতর্কিত নেতারা অনেকেই এখন নতুন করে লবিং করার চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যাদের মধ্যমে পরীক্ষিত নেতাদের তালিকা সংগ্রহ করবেন, তারা তাদের ম্যানেজ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এমনকি একাজে নিয়োজিত গোয়েন্দাদের কোনোভাবে বাগে নেওয়া যায় কিনা তারা অনেকে সে পথও খুঁজছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শুদ্ধি অভিযানের প্রথমদিকে বিতর্কিত যেসব নেতা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, তারাও অনেকে এখন ফিরে আসতে শুরু করেছেন। যারা এ অভিযানের টার্গেট ছিলেন, এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গেছে- তাই আগামীতে নতুন করে আর কিছু হবে না-তারা এমন প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিতর্কিত এসব নেতা আগামী কমিটি থেকে বাদ পড়বেন-এমন ধারণায় যেসব কর্মী তাদের পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন, এদের নতুন করে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন। যদিও এ ধরনের তৎপরতা চালিয়ে তারা মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি।

মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ধারণা, চলমান শুদ্ধি অভিযান দৃশ্যত শিথিল মনে হলেও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বরং বিতর্কিত নেতাদের পিছনে ফেলে কিছুটা অপরিপক্ব ত্যাগী নেতাদের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। তাই শুদ্ধি অভিযানে ধরপাকড় বন্ধ হলেও দুর্নীতিবাজ নেতাদের কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার আশা পুরোপুরিই ভেস্তে যাবে। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবাজ নেতাদের সহযোগী ক্যাডাররাও কোনো ঝুঁকি নিচ্ছেন না বলে জানান তারা।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, শুদ্ধি অভিযানে স্থবিরতা নেমেছে ভেবে যেসব বিতর্কিত নেতা নতুন কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার আশা করছেন, তারা রীতিমত বোকার স্বর্গরাজ্যে বাস করছেন। ক্যাসিনো, জুয়া, অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান এত দিন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা বরং ধীরে ধীরে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তর ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিস্তৃত করা হচ্ছে। শুধু বিতর্কিত নেতাই নয়, অপরাধ-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মীও ছাড় পাবে না বলে সূত্রটি দাবি করে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দুভাবেই তার বার্তা পাঠিয়েছেন। দলীয়ভাবে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছেন চিঠি দিয়ে। কাউকে কাউকে মৌখিক ও বার্তাবাহকের মাধ্যমে সংগঠন থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সরাসরি বার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা প্রথমে ক্যাসিনো ও জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, নব্য আওয়ামী লীগার হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো নেতা এবং বিতর্কিত কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের চিহ্নিত করছেন। পরে তথ্য যাচাই-বাছাই করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। চিহ্নিত কেউ যাতে বিদেশে পালাতে না পারেন, গোয়েন্দারা সেটিও নিশ্চিত করছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<78845 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1